ঢাকা ০২:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৩:১৪:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ অক্টোবর ২০২২
  • / 32

খেজুরের রস সংগ্রহ করছেন গাছি (ছবি : নিউজ লাইট ৭১)

শরৎকে বিদায় জানিয়ে হেমন্ত ঋতুকে বরণ করতে যাচ্ছে প্রকৃতি। বৈচিত্র্যপূর্ণ ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রকৃতি এখনো হেমন্ত ঋতুকে বরণ করে নিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যে এখন রাতের শেষে কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা।

গ্রামের পুবালি বাতাসে অপরূপ সৌন্দর্যে সকলের মন মাতিয়ে তুলছে মিষ্টি খেজুর রসের ঘ্রাণ। কাক ডাকা ভোরে রস সংগ্রহ ও সন্ধ্যায় চলছে গাছ পরিচর্যার কার্যক্রম। প্রান্তিক জনপদে সকালের শিশিরের সাথে অনুভূত হচ্ছে মৃদু শীত। শেষ রাতে অনুভূত হয় শীতের আভাস।

আর মাত্র কয়েক দিন পর রস সংগ্রহ করে রস থেকে লালি ও গুড় তৈরির পর্ব শুরু হয়ে চলবে প্রায় মাঘ মাস পর্যন্ত। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে চোখে পড়ছে। বিশেষ করে উপজেলার জিল বাংলা সুগার মিলের পাশের সারি সারি খেজুরের গাছে রস সংগ্রহের দৃশ্য সকলের নজর কাড়ে। পাশ থেকে যে কেউ এই দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যাবে।

এক সময় খেজুরের রসের গুড় দিয়ে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন পিঠা বানানো হতো। বর্তমানে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ।

কোনো ধরনের পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠত এসব খেজুর গাছ। প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়।

গ্রামীণ জনপদে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে পুকুরের পাড়ে রাস্তার ধারে পরিবেশ বান্ধব খেজুর গাছ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। ইট ভাটার রাহু গ্রাসে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ে তা নির্বিচারে নিধন করায় দিনদিন খেজুর গাছ কমছেই।

এখনো শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম বাংলার খেজুর রস খেতে। এক সময় সন্ধ্যাকালীন সময়ে গ্রামীণ পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠত। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত সে সময়ে। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালী তৈরি করতেন।

যার সাধ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন অবশ্যই সে কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হলেও বাস্তব। যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি মিষ্টি রস দেবে খেজুর গাছ। এ গাছ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার পালা। এ ছাড়া খেজুরর পাতা দিয়ে আকর্ষণীয় ও মজবুত পাটি তৈরি হয়।

এমনকি জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, কালে বিবর্তনসহ বন বিভাগের নজরদারি না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন উপজেলা জুড়ে বিলুপ্তির পথে।

গাছি কালাম মিঞা ও তার সহকর্মীরা নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, আমরা প্রায় প্রতি বছরই খেজুর রস সংগ্রহ করে থাকি। এটাই আমাদের পেশা। রস বিক্রি করে এবং গুড় বানিয়েও বিক্রি করি। বর্তমানে চাহিদা মতো খেজুর গাছ না পাওয়ার কারণে রস কম হওয়ায় আশানুরূপ গুড় তৈরি করতে পাড়ি না। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে না দিয়ে জীবন-জীবিকার জন্য এই পেশা ধরে রেখেছি। তবে যেভাবে খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে অল্প দিনের মধ্যেই এই এলাকায় আর আমাদের ব্যবসা হবে না। বর্তমান বাজারে আখের গুড় চিনি যে মূল্যে বেচাকেনা হচ্ছে তার চেয়ে মানসম্পন্ন খেজুরের গুড়ের দাম এবছর কিছুটা বেশি হবে এমনটাই আসা করছেন গাছিরা।

শীত একটু বেশি পড়তে শুরু করলে আত্মীয়-স্বজন আনা নেয়া ও পিঠা-পুলির উৎসবে খেজুর গুড়ের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সে সময় আমাদের লাভ একটু বেশি হয়। যে পরিমাণে শ্রম দিতে হয় সে পরিমাণে আমরা লাভ করতে পারি না। তবুও পেশাগত কারণে চালিয়ে যাচ্ছি এই ব্যবসা।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল, রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুমে আসার সাথে সাথে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে।

উপজেলার সচেতন মহল মনে করেন, খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে।

নিউজ লাইট ৭১

facebook sharing button
twitter sharing button
pinterest sharing button
email sharing button
sharethis sharing button
Tag :

শেয়ার করুন

খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

আপডেট টাইম : ০৩:১৪:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ অক্টোবর ২০২২

শরৎকে বিদায় জানিয়ে হেমন্ত ঋতুকে বরণ করতে যাচ্ছে প্রকৃতি। বৈচিত্র্যপূর্ণ ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রকৃতি এখনো হেমন্ত ঋতুকে বরণ করে নিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যে এখন রাতের শেষে কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা।

গ্রামের পুবালি বাতাসে অপরূপ সৌন্দর্যে সকলের মন মাতিয়ে তুলছে মিষ্টি খেজুর রসের ঘ্রাণ। কাক ডাকা ভোরে রস সংগ্রহ ও সন্ধ্যায় চলছে গাছ পরিচর্যার কার্যক্রম। প্রান্তিক জনপদে সকালের শিশিরের সাথে অনুভূত হচ্ছে মৃদু শীত। শেষ রাতে অনুভূত হয় শীতের আভাস।

আর মাত্র কয়েক দিন পর রস সংগ্রহ করে রস থেকে লালি ও গুড় তৈরির পর্ব শুরু হয়ে চলবে প্রায় মাঘ মাস পর্যন্ত। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে চোখে পড়ছে। বিশেষ করে উপজেলার জিল বাংলা সুগার মিলের পাশের সারি সারি খেজুরের গাছে রস সংগ্রহের দৃশ্য সকলের নজর কাড়ে। পাশ থেকে যে কেউ এই দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যাবে।

এক সময় খেজুরের রসের গুড় দিয়ে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন পিঠা বানানো হতো। বর্তমানে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ।

কোনো ধরনের পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠত এসব খেজুর গাছ। প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়।

গ্রামীণ জনপদে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে পুকুরের পাড়ে রাস্তার ধারে পরিবেশ বান্ধব খেজুর গাছ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। ইট ভাটার রাহু গ্রাসে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ে তা নির্বিচারে নিধন করায় দিনদিন খেজুর গাছ কমছেই।

এখনো শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম বাংলার খেজুর রস খেতে। এক সময় সন্ধ্যাকালীন সময়ে গ্রামীণ পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠত। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত সে সময়ে। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালী তৈরি করতেন।

যার সাধ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন অবশ্যই সে কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হলেও বাস্তব। যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি মিষ্টি রস দেবে খেজুর গাছ। এ গাছ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার পালা। এ ছাড়া খেজুরর পাতা দিয়ে আকর্ষণীয় ও মজবুত পাটি তৈরি হয়।

এমনকি জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, কালে বিবর্তনসহ বন বিভাগের নজরদারি না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন উপজেলা জুড়ে বিলুপ্তির পথে।

গাছি কালাম মিঞা ও তার সহকর্মীরা নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, আমরা প্রায় প্রতি বছরই খেজুর রস সংগ্রহ করে থাকি। এটাই আমাদের পেশা। রস বিক্রি করে এবং গুড় বানিয়েও বিক্রি করি। বর্তমানে চাহিদা মতো খেজুর গাছ না পাওয়ার কারণে রস কম হওয়ায় আশানুরূপ গুড় তৈরি করতে পাড়ি না। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে না দিয়ে জীবন-জীবিকার জন্য এই পেশা ধরে রেখেছি। তবে যেভাবে খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে অল্প দিনের মধ্যেই এই এলাকায় আর আমাদের ব্যবসা হবে না। বর্তমান বাজারে আখের গুড় চিনি যে মূল্যে বেচাকেনা হচ্ছে তার চেয়ে মানসম্পন্ন খেজুরের গুড়ের দাম এবছর কিছুটা বেশি হবে এমনটাই আসা করছেন গাছিরা।

শীত একটু বেশি পড়তে শুরু করলে আত্মীয়-স্বজন আনা নেয়া ও পিঠা-পুলির উৎসবে খেজুর গুড়ের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সে সময় আমাদের লাভ একটু বেশি হয়। যে পরিমাণে শ্রম দিতে হয় সে পরিমাণে আমরা লাভ করতে পারি না। তবুও পেশাগত কারণে চালিয়ে যাচ্ছি এই ব্যবসা।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাছিদের খেজুর গাছ কাটার কাজটি শিল্প আর দক্ষতায় ভরা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌশল, রয়েছে ধৈর্য ও অপেক্ষার পালা। এ জন্য মৌসুমে আসার সাথে সাথে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়ে।

উপজেলার সচেতন মহল মনে করেন, খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে।

নিউজ লাইট ৭১

facebook sharing button
twitter sharing button
pinterest sharing button
email sharing button
sharethis sharing button