বিরল স্থলবন্দরে খুলছে বাণিজ্যের নতুন দুয়ার
- আপডেট টাইম : ০৫:৪৮:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ অক্টোবর ২০২০
- / 75
৭১: দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর সচল করতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পিছিয়ে নেই ভারতের অভ্যন্তরের রাধিকাপুর অংশটিও। কারণ, সড়কপথে সরাসরি যাত্রীসহ পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশ-ভারত একমত বলে খবর চাওড় হয়েছে। খবরটিতে পাশের দেশগুলোর মধ্যেও শুরু হয়েছে বাণিজ্যের হিসাবনিকাশ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সব পক্ষের মধ্যে নীতিনির্ধারণী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমঝোতা হলে যুগ যুগ ধরে আলোচনায় থাকবে উত্তর জনপদের এই বন্দর। আর বিরল বাণিজ্যের সাক্ষী হবে ‘বিরল’ স্থলবন্দর। এতে খুলবে আন্তঃরাষ্ট্র বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। আমদানি-রফতানি সহজ হবে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে।
সূত্র মতে, সড়কপথের মধ্যে দেশের অন্যতম স্থলবন্দর দিনাজপুরের বিরল। বন্দরটি চালু হলে রেল ও সড়কপথে চারটি দেশে (বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল) পণ্য আমদানি-রফতানির দুয়ার খুলে যাবে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চুক্তির কার্যক্রম সম্পন্ন হলে দুদেশের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরটি সচল হওয়া মাত্রই বিশাল অঙ্কের বাণিজ্যের সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হবে। রাজস্ব আহরণের সঙ্গে বন্ধু-প্রতিম ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যোগসূত্র স্থাপন হবে। এই পথটিকে ব্যবহার হরে সরাসরি ভারত হয়ে অন্যান্য দেশেও সাধারণ মানুষের যাতায়াত সহজ হবে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছরের মতো এ বছরও দুদিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। ওই সম্মেলনে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিরল স্থলবন্দর চালু হলে রাষ্ট্র কী ধরনের সুবিধা পাবে, সে বিষয় উল্লেখ করে লিখিত প্রস্তাব দেন। তিনি তার প্রস্তাবে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সঙ্গে সড়কপথে আরো বন্দর রয়েছে। তবে, বিরল স্থলবন্দর ওই বন্দরগুলো থেকে গভীর কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ, সড়কপথে সরাসরি পণ্য পরিবহনে শুধু ভারত নয়; নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও সেতুবন্ধ রচিত হবে। এ বন্দর থেকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আসবে। দুই পক্ষের (বাংলাদেশ-ভারত) মধ্যে চুক্তি হলে, এক দিনে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে দুই পক্ষের মানুষের পাশের দেশগুলোতেও যাতায়াত সহজ হবে।
ডিসির এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিরল স্থলবন্দর এবং ভারতের রাধিকাপুর এলসিএসের মাধ্যমে সড়কপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে রুট ঘোষণার জন্য গত বছরের ২৪ জুন স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে নৌ-মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেন বন্দরটি চালু করতে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়।
চিঠির জবাব পেতে বিলম্ব হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২৯ মার্চ আগের চিঠির আদলে দ্বিতীয় তাগিদপত্র দেয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। দুই দফা চিঠি ও ডিসির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত জুলাইয়ে (১৮-২০) সাব-গ্রুপ অন ইনফ্রাস্ট্রাকচার অব এলসিএস-আইসিএস সভায় বিরল স্থল রুট চালু করার বিষয়ে দুদেশ (বাংলাদেশ-ভারত) একমত পোষণ করেছে মর্মে নৌ-মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ অবহিত হন। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে উভয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চলছে কূটনৈতিক তৎপরতা।
নৌ-মন্ত্রণালয় বলছে, দুদেশ সমঝোতায় এলে সড়কপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিরল স্থলবন্দরের দ্বার উন্মুক্ত হবে। সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতির চাকা। কর্মসংস্থান হবে লাখ লাখ মানুষের।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর এবং ভারতের রাধিকাপুর এলসিএসের মাধ্যমে সড়কপথে বাণিজ্য চালুর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বন্দরটি সচল করতে বন্ধু-প্রতিম ভারত-বাংলাদেশ একমত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব আরো বলেন, শুধু বন্দরটি চালু করলেই হবে না। দুদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেকগুলো বিষয় রয়েছে, সেগুলোতে দুদেশের নীতিনির্ধারকদের একমত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে আলোচনা ফলপ্রসূ হলে বন্দরটি চালু করার ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হবে বলে জানান নৌপরিবহন সচিব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিরল স্থলবন্দরটির সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শনে যান রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। পরিদর্শনকালে উভয়ই স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ বন্দরটি চালু করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, বঙ্গবন্ধু-তনয়ার এই অঙ্গীকার এবার বাস্তবায়ন করা হবে। এর জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সবই নিতে উভয় মন্ত্রণালয় সম্মত আছে। দুই মন্ত্রীই বলেছিলেন, বিরল স্থলবন্দর চালু হলে ওই এলাকার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে চার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সেখানকার বাসিন্দারা এখন পর্যন্ত হিলি স্থলবন্দর ব্যবহার করে তাদের পণ্য আমদানি করছে। এ বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি শুরু করলে তাদের খরচ অনেক কমবে। তারা আরো বলেন, বন্দরটি চালু হলে স্থানীয়দের মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে—এমন আশায় বন্দরের জন্য আমরা জমি দিয়েছি। শুনেছি শিগগিরই বন্দরটি চালু হতে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশ ও পরবর্তী সময়ে দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে ভারতের রাধিকাপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন করা হতো প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে। ২০০৫ সালে ভারতীয় এলাকায় রেলপথ ব্রডগেজে রূপান্তর করা হলে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। বন্ধ হওয়ার পর দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা ইস্যুতে সমঝোতা না হওয়ায় আর চালু হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, লাভজনক ওই রেলপথে আবার চার দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ২৫ বছরের জন্য বিরল স্থলবন্দর লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০০৬ সালে। ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে আসা পণ্য স্থলবন্দরে খালাস হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য সড়ক নির্মাণে ৭১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়। তবে, বাণিজ্যিক কার্যক্রম আবার চালুর আশায় বাংলাদেশ সরকার ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালে মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সালে পণ্য পরিবহন ও যাত্রীবহন সহজ করতে আধুনিকায়ন করা হয়েছে রেলপথসহ বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশন। এখন স্থলবন্দরটি চালু হলে পাশের চার দেশের মধ্যে সড়কপথে নতুন মেরূকরণের পাশাপাশি সেতুবন্ধ রচিত হবে। উন্মুক্ত হবে বাণিজ্যের দ্বার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরে শুরু হওয়া কার্যক্রমে ইতোমধ্যে দৃশ্যমান স্থলবন্দরটি। সেখানে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিজিবি চেকপোস্টের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
স্থলবন্দর পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু সড়কপথেই নয়, এ বছরই শুরু হতে পারে রেলপথে পণ্য আমদানি-রফতানিও। এজন্য রেলওয়ের সাইটলাইন নির্মাণের জন্য ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে।