রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিশ্বকে পদক্ষেপ নিতে হবে: প্রধানমন্ত্রী
- আপডেট টাইম : ১২:৪৭:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯
- / 86
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মিয়ানমারের কারণে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আমরা এ সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ ও তাৎক্ষণিক সমাধান চাই। মিয়ানমারই এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারেই রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বুধবার বিকালে মার্কিন থিংকট্যাংক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’ (সিএফআর) আয়োজিত ‘এ কনভারসেশন উইথ প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অভূতপূর্ণ অর্থনৈতিক সাফল্যের বিবরণ তুলে ধরার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কথা বলেন।
তিনি সন্ত্রাস ও উগ্র চরমপন্থাকে সামাজিক ব্যাধি আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য চার দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবগুলো হল- সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের জোগান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
তাদের অর্থের জোগান বন্ধ করতে হবে। সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। মিয়ানমার পরিকল্পিত নৃশংসতার মাধ্যমে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নিধন শুরু করে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গারা নৃশংসতা ও সন্ত্রাস থেকে পালিয়েছিল।
আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে সীমান্ত খুলে দেই। সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা করছে।
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এসব শিবির পরিদর্শনে এসে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা রোহিঙ্গাদের নিধনযজ্ঞের বিভিন্ন নৃশংস ঘটনাবলি শুনলে আপনারা কেঁপে উঠবেন। আপনাদের হৃদয় যন্ত্রণায় দগ্ধ হবে এবং আপনারা শিগগিরই রোহিঙ্গাদের এসব বেদনাদায়ক পরিস্থিতির অবসান চাইবেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় নেয়ার কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর আমি নিজেও শরণার্থী হয়ে পড়েছিলাম। কেবলমাত্র আমি ও আমার ছোট বোন শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের আলোচনা হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ আলোচনা প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানিয়েছে।
তিনি বলেন, সমস্যা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে বলে দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছে না। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সংবিধান পরিবর্তন করে রোহিঙ্গাদের কীভাবে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, সে কথাও তিনি তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের উচিত এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে গিয়ে নিজ ভূমিতে বসবাস করতে পারে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠন চায় না এসব লোক তাদের দেশে ফিরে যাক। সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের আটকানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, যদি আমরা ভাসানচর দ্বীপে তাদের স্থানান্তর করতে পারি, তাহলে কিছু লোক কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে এবং তাদের শিশুরা শিক্ষার সুবিধা পাবে।
সন্ত্রাস ও উগ্র চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কারণে ২০০৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার পর আর কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারেনি। আমাদের জনগণ এখন সতর্ক রয়েছে। সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম ও সীমানা নেই।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের জন্যই বিশ্বব্যাপী বছরজুড়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ২০০৯’ প্রণয়নের কথা উল্লেখ তিনি বলেন, এ প্ল্যানের আওতায় নিজস্ব সম্পদের দ্বারা বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে। এরপর কয়েকশ’ প্রকল্পে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনীতি, সরকার, জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সংস্থা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থা এবং এমনকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রে নারীরা উচ্চপদে আসীন। তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যথাসময়েই এমডিজি অর্জন করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বাস্তবমুখী জননীতির মাধ্যমে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আমাদের নতুন স্লোগান- ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’। তিনি বলেন, আইএমএফ রিপোর্ট-২০১৯-এ বাংলাদেশ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি এবং পিপিপি হিসেবে বিশ্বের ৩০তম বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ হচ্ছে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ।
মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের বিষয়ে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি যখন মক্কায় ওআইসি সম্মেলনে অংশ নিয়েছি তখন এই ইস্যু উত্থাপন করেছিলাম- মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যখন কোনো সমস্যা দেখা দেবে, তখন তা সংলাপ অথবা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
আপনারা জানেন কোথায় এই সমস্যা নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, প্রত্যেকবার আমি ওআইসিতে এ ইস্যু তুলেছি এবং এসব বিষয়ে ওআইসি কিছু পদক্ষেপ নেবে আশা করেছি। কিন্তু যে কারণেই হোক তা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ, সিএফআর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এন হাস এবং সিএফআর’র সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।