আগ্রহের গৃহঋণে অনাগ্রহ
- আপডেট টাইম : ০৪:০৯:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ অগাস্ট ২০২০
- / 92
৭১: সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক আগ্রহের মুখে গৃহঋণ প্রকল্প চালু হয় দীর্ঘ এক যুগ পর। দুই বছর ধরে চলমান এ প্রকল্প। কিন্তু ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে এ ঋণ গ্রহণ করেছেন মাত্র ৪৮০ জন। যা মোট সরকারি কর্মকর্তার তুলনায় খুবই কম।
প্রকল্পটি শুরুর আগে ব্যাপক আগ্রহ থাকার পরও গৃহঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা অনাগ্রহী কেন- এমন প্রশ্ন ছিল অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত নীতিমালা অত্যন্ত জটিল। এ ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ মাসিক কিস্তির হার নির্ধারণ করা হয়, তা কোনো কোনো কর্মকর্তার মোট বেতনের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। অনেকের ক্ষেত্রে তা বেতনের সমান। ফলে মাসে উপার্জিত সব টাকা ঋণ পরিশোধ করলে জীবনযাপনে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়।
এ কারণে অনেকে গৃহঋণে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গিয়েও কর্মকর্তাদের পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, একজন সরকারি আমলার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া মানতে হচ্ছে। ব্যাংকে দাখিল করতে হচ্ছে একই ধরনের কাগজপত্র, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। এক্ষেত্রে যে ফ্ল্যাট ক্রয় করা হবে বা জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ করার জন্য ঋণ গ্রহণ করা হবে, তা ভিজিট করে ক্রয় নিশ্চিত জেনেই লোন পাস করে ব্যাংকগুলো। অনেক ক্ষেত্রে ভিজিট প্রক্রিয়া এতটাই ধীর গতির, যা অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। এ ছাড়াও কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যে আইনজীবী বা আইন উপদেষ্টাকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব দেন, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন বলেও অভিযোগ ওঠে। সাধারণ মানুষকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও আইনজীবীর যে মনোভাব, একই মনোভাব সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও পোষণ করা হচ্ছে। সরকারের আমলা হিসেবে ন্যূনতম কোনো সুবিধা বা সম্মানও দেখানো হয় না এক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ সচিবালয়ে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ প্রক্রিয়ায় সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা ও আইনজীবী উপঢৌকন অথবা অতিরিক্ত সুবিধা প্রাপ্তিতে অভ্যস্ত। যা সরকারি কর্মকর্তারা দিতে অনাগ্রহ দেখান। ফলে ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় করতে অনেক বেগ পেতে হয়। অর্থ বিভাগে নিয়োজিত গৃহঋণের দায়িত্ব পালন করা উপসচিব দিল আফরুজা নিজেও গৃহঋণ গ্রহণ করেননি। তিনি জানান, ঋণ নিতে চাইলে ফ্ল্যাট বা জমি নির্ধারণ করে তারপর ঋণ নিতে হয়। অনেক সময় ঋণের পরিমাণের সঙ্গে ফ্লাটের দাম মেলানো যায় না। এভাবে নানা জটিলতার কারণে আমি নিজেও ঋণ নিতে পারিনি। আমার স্বামীও সরকারি কর্মকর্তা। এখন ভাবছি দুজন মিলে ঋণ নিয়ে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, গৃহঋণ গ্রহণের নীতিমালা অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর সুদের যে পাঁচ শতাংশ ভর্তুকি সুবিধা সরকার দেয়, তা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে পুরো সুদ অর্থাৎ ৯ শতাংশের পুরোটাই ঋণ গ্রহীতাকে বহন করতে হয়। এটা বড় সমস্যা। সুদ মওকুফের সুবিধা শুধু চাকরিতে বহাল থাকাকালীন এবং এলপিআরের এক বছর পর্যন্ত পাওয়া যায়। ফলে অনেকে গৃহঋণ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের গৃহঋণ শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেন, একজন কর্মকর্তা যতদিন পেনশন পাবেন সে মেয়াদ পর্যন্ত যদি সরকারের দেওয়া ঋণের সুদ সুবিধা পেতেন, তবুও হয়তো অনেকে আগ্রহ দেখাতেন। এক্ষেত্রে গৃহ ঋণের এ নীতিমালার সংশোধনের দাবিও তুলেছেন তিনি।
গৃহঋণের নীতিমালার সমালোচনা করে একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ কোনো মানুষ ব্যাংক থেকে লোন নিলে শুধু তাকে জমি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রাখতে হয়। কিন্তু একজন কর্মকর্তা গৃহঋণ নিতে গেলে তার পুরো বেতন ও যে সম্পদের ওপর ঋণ গ্রহণ করছেন, তাও বন্ধক রাখতে হয়। এক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তাকে বাধ্য হয়েই একটি ঋণের বিপরীতে দুটি বন্ধক একসঙ্গে রাখতে হচ্ছে। ফলে গৃহঋণ গ্রহণে কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও যেসব কর্মকর্তা গৃহঋণ গ্রহণ করবেন, তাদের অনলাইন পদ্ধতিতে বেতন-ভাতা গ্রহণের আওতায় আসতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে যেসব কর্মকর্তা নিয়োজিত, তাদের শতভাগ অনলাইন পদ্ধতিতে বেতন-ভাতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে গৃহঋণ নীতিমালার এ জটিলতার ফলে অনেকে ঋণ গ্রহণে আবেদনই করতে পারছেন না।
ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমাদানের বিষয়ে নানা জটিলতার কথা উল্লেখ করেন একাধিক সরকারি কর্মকর্তা। তারা বলেন, সরকারের একজন সচিব, অতিরিক্ত সচিব অথবা যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার লোনপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কাগজপত্র নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া সম্ভব হয় নয়। অনেক ক্ষেত্রে এটা বিড়ম্বনা তৈরি করে। ফলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা গৃহঋণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
গৃহঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, আগে ফ্ল্যাট ক্রয় করতে হবে অথবা বাড়ি নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় করতে হবে। এরপর ঋণ বাবদ অর্থ অনুমোদন দেয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে মর্গেজ যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের দিলে তা সুবিধাজনক হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, তফসিলি চার ব্যাংকসহ মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এ ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিড়ম্বনার বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক-এমডি মোহাম্মাদ সাম্ছ-উল ইসলাম বলেন, এটা লোনের ব্যাপার। দীর্ঘমেয়াদি লোনের ব্যাপারে কাগজপত্র ও আইনগত বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ে একটু সময় লাগছে। তারপরও আমার মনে হয় এত বেশি সময় লাগার কথা নয়।
যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে, এটা তেমন বড় কোনো সমস্যা নয়। তিনি বলেন, তবে আমার ব্যাংকে এমন বিড়ম্বনার কথা আমার কাছে এলে দেখব। তবে লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের যে নিয়ম, তা মানতেই হবে। আইনজীবীদের মাধ্যমে যে কাগজপত্র নেওয়া হয়, সেটা দিতে হবে। তবে ব্যাংকের কারণেই সরকারি কর্মকর্তাদের গৃহঋণ নিতে অনাগ্রহ আছে, এটা মানতে নারাজ এই কর্মকর্তা।