ঢাকা ০৩:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইলিশের দাম ২০২৫ টাকা!

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০১:১৫:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অগাস্ট ২০২৪
  • / 17

ছবি: সংগৃহীত

আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র ইলিশের ভরা মৌসুমেও ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। এদিকে ইলিশের দাম নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও এ অঞ্চলে এই মৌসুমে এক কেজির নিচের ইলিশ খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো। এক কেজির ওপরেরগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।

প্রদীপ বিশ্বাস আক্ষেপ করে গণমাধ্যমকে বলেন, বাচ্চারা ইলিশ খেতে বায়না ধরেছে। কিন্তু দাম শুনে আর সাহস হলো না। মৌসুমেও যদি ইলিশের এত দাম হয়, তাহলে মানুষ কিনবে কীভাবে! আর কেনই-বা এখনো এত দাম?

প্রদীপ বিশ্বাসের মতোই দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও এ অঞ্চলে এই মৌসুমে এক কেজির নিচের ইলিশ খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো। এক কেজির ওপরেরগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।

সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, নদী-সাগর থেকে আহরিত ইলিশ খুচরা বাজারে ক্রেতাদের কাছে আসতে চার দফা হাতবদল হয়। যার প্রতিটি ধাপে বাড়ে ইলিশের দাম। এই ধাপগুলোকে ‘চোরা ফাঁদ’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরগুনার পাথরঘাটায় একজন জেলে একটি এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করে ১ হাজার ৩৫০ টাকা পান। ক্রেতাদের সেই ইলিশ কিনতে হয় ২ হাজার ২৫ টাকায়। এই অতিরিক্ত ৬৭৫ টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।

জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী পাইকারি বাজারে ইলিশের দাম নির্ধারণ করে দেয় এই আড়তদারেরা। কারণ, আড়তদারেরা জেলেদের মধ্যে দাদন দেয়। মাছের আহরণ ও দাম যত বাড়বে, তত বেশি তাঁরা কমিশন (সুদ) পাবেন। ফলে আড়তদারদের ফাঁদেই ইলিশের দামে বড় কারসাজি হচ্ছে। এ ছাড়া জ্বালানির দাম দ্বিগুণ হওয়া ছাড়াও বরফ, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইলিশ আহরণে এখন ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর প্রভাব পড়ছে বাজার ব্যবস্থায়।

সাগর ও নদী থেকে আহরণ করা ইলিশ আসে পাইকারি বাজার ঘাটে। সেখানে যে ট্রলারের জেলে যে আড়ত থেকে দাদন নিয়েছেন, সেই আড়তেই মাছ বিক্রির জন্য দিতে হয়। এর বিনিময়ে আড়তদার বিক্রীত মাছ থেকে কমিশন পান। আড়তদাররা মৌসুমে জেলেপ্রতি দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন দেন। এ জন্য আড়তদারদের শর্ত হচ্ছে দাদনের অর্থ আসল হিসেবে থাকবে এবং আহরিত মাছ বিক্রি করে মুনাফা হিসেবে কেটে রাখবেন। এটাকে তাঁরা কমিশন নাম দিয়েছেন।

আড়তদারদের এসব মাছ বিক্রি করেন পাইকাররা। এতে পাইকাররাও একটি নির্ধারিত কমিশন পান। এই মাছ কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানের বড় মোকামে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। সেখানে নিয়ে তাঁরা আরেক দফা লাভে বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা আরেক দফা মুনাফার পর তা সরাসরি ক্রেতার হাতে যায়।

পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য আড়তদার মালিক সমিতির সহসভাপতি আলম মোল্লা বলেন, চারটি ধাপের প্রতিটিতেই ব্যবসা জড়িত। আবার অনেক প্রভাবশালীর স্বার্থও এখানে জড়িয়ে থাকে। তাই এককভাবে কেউ চাইলেই এটা কমাতে পারেন না। তা ছাড়া ইলিশ রাজকীয় মাছ, তাই সব সময়ই এর বাজার ঊর্ধ্বমুখী রাখেন বড় ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে ভোলা সদরের ইলিশা জংশন মাছ ঘাটে গিয়ে কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলে আমান সুতার জাল নিয়ে মেঘনায় একদিন-একরাতে মাছ পেয়েছেন মাত্র পাঁচশ টাকার। কিন্তু এই মাছ শিকার করতে তার খরচ হয়েছে সাড়ে নয় হাজার টাকা।

জেলে সাহাবুদ্দিন পেয়েছেন এক হাজার তিনশ টাকার মাছ। এর বিপরীতে তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা।

নিষিদ্ধ হলেও অনেক জেলে কারেন্ট জাল দিয়েও মাছ শিকার করছেন নদীতে। তেমনি এক জেলে নাম না প্রকাশের শর্তে কারেন্ট জাল নিয়ে পেয়েছেন দুই হাজার একশ পঞ্চাশ টাকার মাছ। তবে তার খরচ হয়েছে ১১ হাজার টাকা।

কারেন্ট জাল ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনিসহ অন্য জেলেরা জানান, এখন কিছু ইলিশ মাছ পাওয়া যায় ভোলা থেকে অনেক দূরে সাগর মোহনার হাতিয়া, সুবর্ণচর এলাকায়। সেখানে যেতে জ্বালানি তেল লাগে অনেক বেশি। নিতে হয় কারেন্ট জাল। কারণ সুতার জালে মাছ তেমন আটকায় না। নদীতে মাছ না পাওয়ার কথা জানান শিবপুরের ভোলার খাল এলাকার জেলে মোহাম্মদ আবু কাশেমও।

মাছ কমে যাওয়ার বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব বলেন, সাগর মোহনার পরে ভোলার চরফ্যাশন থেকে উত্তরে অনেক ডুবোচর। তাই সেখানে পানির গভীরতা কম। ইলিশ গভীর পানির মাছ। অনেক সময় ডুবোচরের কারণে সামনে এগোতে চায় না, তাই মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলে ইলিশ কম পাওয়া যায়।

এদিকে সুতার জালে ইলিশ আটকায় না জেলেদের এমন কথার সঙ্গে একমত নন এই মৎস্য কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সুতার জালের চেয়ে অবৈধ কারেন্ট জাল সহজলভ্য এবং দাম কম। জেলেরা তাই কারেন্ট জালের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ মাছের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গত এক দশকে দেশের পাইকারি থেকে খুচরা মোকাম পর্যন্ত একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা খুব দুরূহ। সরকার বদল হলেও নতুন যাঁরা আসেন, তাঁরা এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন।

নিউজ লাইট ৭১

 

Tag :

শেয়ার করুন

ইলিশের দাম ২০২৫ টাকা!

আপডেট টাইম : ০১:১৫:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অগাস্ট ২০২৪

আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র ইলিশের ভরা মৌসুমেও ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। এদিকে ইলিশের দাম নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও এ অঞ্চলে এই মৌসুমে এক কেজির নিচের ইলিশ খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো। এক কেজির ওপরেরগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।

প্রদীপ বিশ্বাস আক্ষেপ করে গণমাধ্যমকে বলেন, বাচ্চারা ইলিশ খেতে বায়না ধরেছে। কিন্তু দাম শুনে আর সাহস হলো না। মৌসুমেও যদি ইলিশের এত দাম হয়, তাহলে মানুষ কিনবে কীভাবে! আর কেনই-বা এখনো এত দাম?

প্রদীপ বিশ্বাসের মতোই দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও এ অঞ্চলে এই মৌসুমে এক কেজির নিচের ইলিশ খুচরা বাজারে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো। এক কেজির ওপরেরগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়।

সাধারণ ক্রেতাদের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, নদী-সাগর থেকে আহরিত ইলিশ খুচরা বাজারে ক্রেতাদের কাছে আসতে চার দফা হাতবদল হয়। যার প্রতিটি ধাপে বাড়ে ইলিশের দাম। এই ধাপগুলোকে ‘চোরা ফাঁদ’ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরগুনার পাথরঘাটায় একজন জেলে একটি এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করে ১ হাজার ৩৫০ টাকা পান। ক্রেতাদের সেই ইলিশ কিনতে হয় ২ হাজার ২৫ টাকায়। এই অতিরিক্ত ৬৭৫ টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।

জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী পাইকারি বাজারে ইলিশের দাম নির্ধারণ করে দেয় এই আড়তদারেরা। কারণ, আড়তদারেরা জেলেদের মধ্যে দাদন দেয়। মাছের আহরণ ও দাম যত বাড়বে, তত বেশি তাঁরা কমিশন (সুদ) পাবেন। ফলে আড়তদারদের ফাঁদেই ইলিশের দামে বড় কারসাজি হচ্ছে। এ ছাড়া জ্বালানির দাম দ্বিগুণ হওয়া ছাড়াও বরফ, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইলিশ আহরণে এখন ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর প্রভাব পড়ছে বাজার ব্যবস্থায়।

সাগর ও নদী থেকে আহরণ করা ইলিশ আসে পাইকারি বাজার ঘাটে। সেখানে যে ট্রলারের জেলে যে আড়ত থেকে দাদন নিয়েছেন, সেই আড়তেই মাছ বিক্রির জন্য দিতে হয়। এর বিনিময়ে আড়তদার বিক্রীত মাছ থেকে কমিশন পান। আড়তদাররা মৌসুমে জেলেপ্রতি দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন দেন। এ জন্য আড়তদারদের শর্ত হচ্ছে দাদনের অর্থ আসল হিসেবে থাকবে এবং আহরিত মাছ বিক্রি করে মুনাফা হিসেবে কেটে রাখবেন। এটাকে তাঁরা কমিশন নাম দিয়েছেন।

আড়তদারদের এসব মাছ বিক্রি করেন পাইকাররা। এতে পাইকাররাও একটি নির্ধারিত কমিশন পান। এই মাছ কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানের বড় মোকামে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। সেখানে নিয়ে তাঁরা আরেক দফা লাভে বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা আরেক দফা মুনাফার পর তা সরাসরি ক্রেতার হাতে যায়।

পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য আড়তদার মালিক সমিতির সহসভাপতি আলম মোল্লা বলেন, চারটি ধাপের প্রতিটিতেই ব্যবসা জড়িত। আবার অনেক প্রভাবশালীর স্বার্থও এখানে জড়িয়ে থাকে। তাই এককভাবে কেউ চাইলেই এটা কমাতে পারেন না। তা ছাড়া ইলিশ রাজকীয় মাছ, তাই সব সময়ই এর বাজার ঊর্ধ্বমুখী রাখেন বড় ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে ভোলা সদরের ইলিশা জংশন মাছ ঘাটে গিয়ে কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলে আমান সুতার জাল নিয়ে মেঘনায় একদিন-একরাতে মাছ পেয়েছেন মাত্র পাঁচশ টাকার। কিন্তু এই মাছ শিকার করতে তার খরচ হয়েছে সাড়ে নয় হাজার টাকা।

জেলে সাহাবুদ্দিন পেয়েছেন এক হাজার তিনশ টাকার মাছ। এর বিপরীতে তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা।

নিষিদ্ধ হলেও অনেক জেলে কারেন্ট জাল দিয়েও মাছ শিকার করছেন নদীতে। তেমনি এক জেলে নাম না প্রকাশের শর্তে কারেন্ট জাল নিয়ে পেয়েছেন দুই হাজার একশ পঞ্চাশ টাকার মাছ। তবে তার খরচ হয়েছে ১১ হাজার টাকা।

কারেন্ট জাল ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনিসহ অন্য জেলেরা জানান, এখন কিছু ইলিশ মাছ পাওয়া যায় ভোলা থেকে অনেক দূরে সাগর মোহনার হাতিয়া, সুবর্ণচর এলাকায়। সেখানে যেতে জ্বালানি তেল লাগে অনেক বেশি। নিতে হয় কারেন্ট জাল। কারণ সুতার জালে মাছ তেমন আটকায় না। নদীতে মাছ না পাওয়ার কথা জানান শিবপুরের ভোলার খাল এলাকার জেলে মোহাম্মদ আবু কাশেমও।

মাছ কমে যাওয়ার বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব বলেন, সাগর মোহনার পরে ভোলার চরফ্যাশন থেকে উত্তরে অনেক ডুবোচর। তাই সেখানে পানির গভীরতা কম। ইলিশ গভীর পানির মাছ। অনেক সময় ডুবোচরের কারণে সামনে এগোতে চায় না, তাই মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলে ইলিশ কম পাওয়া যায়।

এদিকে সুতার জালে ইলিশ আটকায় না জেলেদের এমন কথার সঙ্গে একমত নন এই মৎস্য কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সুতার জালের চেয়ে অবৈধ কারেন্ট জাল সহজলভ্য এবং দাম কম। জেলেরা তাই কারেন্ট জালের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ মাছের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গত এক দশকে দেশের পাইকারি থেকে খুচরা মোকাম পর্যন্ত একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা খুব দুরূহ। সরকার বদল হলেও নতুন যাঁরা আসেন, তাঁরা এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন।

নিউজ লাইট ৭১