ঢাকা ০৮:১১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৈষম্য নিরসনে করণীয়

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫৯:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ এপ্রিল ২০২৪
  • / 31

বাঙালি এবং বাংলাদেশ সম্পদে ভরপুর ছিল সবসময়। যথাযথ সুযোগ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তির অভাবে বাঙালিরা সেই অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগাতে পারেনি। পাল, সেন, মুঘল, ব্রিটিশ, এমনকি ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান শাসন আমলেও ছিল এই অবস্থা। 

প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদে, প্রাচুর্য্যে ভরপুর বাংলার মানুষকে না খেয়ে, আধা পেটে, ক্ষুধা নিয়ে জীবন ধারণ করতে হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের হাজার বছর ধরে মানুষের অবস্থা ছিল এরকমই। বরং তথ্য প্রমাণ আছে বাংলার সম্পদে পাল, সেন, মুঘল, ব্রিটিশ, এমন কি ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক, শোষক চক্রতাদের আখের গুছিয়েছে আর তাদের দেশের মানুষের ভাগ্য বদল করেছে। এভাবে বাংলাকে শোষণ, আর সম্পদ পাচার করে এদেশের মানুষকে, মানুষের ভাগ্যকে, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ধাবিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে হাজার বছর ধরে। তবুও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বীর বাঙালি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।

১৭৫৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের আন্দোলন সংগ্রাম পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যঅস্তমিত হলে বাঙালিতে পরাধীনতা শৃঙ্খলে ফের আবদ্ধ হতে হয়।  কিন্তু ‘‘পরাজয়ে ডরে না বীর,’’ বাঙালি পরাধীনতা শৃঙ্খল ভাঙতে বিভিন্ন সময়ে নানা নামে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে, অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে ক্ষমতাসীনদের হাতে, অথবা বন্দি হয়েছে, কারা ভোগ করেছেন।

এ পর্যায়ে হাজি শরীয়ত উল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন। মূলত ফরায়েজি আন্দোলন হলো একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯ শতকের প্রথম দিকে এটি সূচিত হয়েছিল। ফরায়েজি আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে সূচিত হলেও পরবর্তীতে কৃষকদের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। পরবর্তীতে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, নাচোলে ইলা মিত্রের বিদ্রোহ, চট্টগ্রামে মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের  অংশ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন। এসব আন্দোলনের ধারবাহিকতায় ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে রাজপথে নেমে আসে দেশের ছাত্রসমাজ। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রক্তের বিনিময়ে অবশেষে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলার অধিকার অর্জন করি।

পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনের নামে এদেশের সম্পদ সে দেশে পাচার, লুণ্ঠন, শোষণ, নিপীড়ন নির্যাতন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে বীর বাঙালি। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে এসে স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র কতিপয় উচ্চ বিলাসী এবং বিপথগামী সেনা সদস্য সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। দীর্ঘ ২১ বছর দেশ শাসন করেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও স্বৈরাচার।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এখন শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় দ্রুত এগুচ্ছে। কিন্তু যে বৈষম্যের কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার লক্ষ্য ধনী-গরিবের বৈষম্য নিরসন এখনো সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান শাসনামলে এদেশে ২৪ কোটি পতি পরিবারের স্থলে এখন প্রায় লক্ষাধিক কোটি পতি পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য।

এদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অর্জন সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর যেখানে শুধু ভাত ও রুটির ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। পাঁচ দশকের ব্যবধানে সেখানে  মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি ও ফলমূল উৎপাদনেও রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সবমিলিয়ে খাদ্যে অর্জন করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এ কারণে দেশ একটু একটু করে পৌঁছে গেছে সমৃদ্ধির সোপানে। সেই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, স্যানিটেশনসহ অনেক সূচকে ৫৩ বছর বয়সে বহুদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু অভ্যন্তরেই নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলেও সুনাম কুড়াচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন বিশ্ববাজারে অধিক সমাদৃত। ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। এক সময়ের ভুখা, দরিদ্র বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তবে অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবে বেড়েছে ধরী-গরিবের বৈষম্য। ধনীরাই দিন দিন ধনী হচ্ছেন। আর গরিবরা হচ্ছে অতি গরিব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বিদায় অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা, যা আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ টাকা। শুধু তাই নয় দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও গড়ে বেশি আয় করেন। মাথাপিছু এ আয়ের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়েছে দেশ। অথচ দুই দশক আগেও ভারত ও পাকিস্তান বেশ এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যেই মাথাপিছু জিডিপিতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শক্তির দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অনন্য মডেল বাংলাদেশ।

হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং-টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কম পক্ষে ১৬ ধাপে উন্নীত হবে। যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এইচএসবিসির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন মডেলে দেখানো হয়েছে, ২০৩০ পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যা রিপোর্টে উল্লিখিত ৭৫টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৭ শতাংশ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে  দেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০৩০ সালে পৌঁছাবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে।

এখন সময় এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সামনে দেশকে সোনার বাংলা তৈরি করার। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য।’ আরেক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদের সঙ্গে কোনোদিন এক হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে তারই সুযোগ্য কন্যা দেশকে এগিয়ে নেয়ার মহতী প্রয়াস অব্যাহত রাখবেন এ প্রত্যাশা থাকল।

নিউজ লাইট ৭১

Tag :

শেয়ার করুন

বৈষম্য নিরসনে করণীয়

আপডেট টাইম : ০৯:৫৯:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালি এবং বাংলাদেশ সম্পদে ভরপুর ছিল সবসময়। যথাযথ সুযোগ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তির অভাবে বাঙালিরা সেই অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগাতে পারেনি। পাল, সেন, মুঘল, ব্রিটিশ, এমনকি ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান শাসন আমলেও ছিল এই অবস্থা। 

প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদে, প্রাচুর্য্যে ভরপুর বাংলার মানুষকে না খেয়ে, আধা পেটে, ক্ষুধা নিয়ে জীবন ধারণ করতে হয়েছে। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের হাজার বছর ধরে মানুষের অবস্থা ছিল এরকমই। বরং তথ্য প্রমাণ আছে বাংলার সম্পদে পাল, সেন, মুঘল, ব্রিটিশ, এমন কি ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক, শোষক চক্রতাদের আখের গুছিয়েছে আর তাদের দেশের মানুষের ভাগ্য বদল করেছে। এভাবে বাংলাকে শোষণ, আর সম্পদ পাচার করে এদেশের মানুষকে, মানুষের ভাগ্যকে, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে ধাবিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে হাজার বছর ধরে। তবুও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বীর বাঙালি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে।

১৭৫৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের আন্দোলন সংগ্রাম পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যঅস্তমিত হলে বাঙালিতে পরাধীনতা শৃঙ্খলে ফের আবদ্ধ হতে হয়।  কিন্তু ‘‘পরাজয়ে ডরে না বীর,’’ বাঙালি পরাধীনতা শৃঙ্খল ভাঙতে বিভিন্ন সময়ে নানা নামে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে, অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে ক্ষমতাসীনদের হাতে, অথবা বন্দি হয়েছে, কারা ভোগ করেছেন।

এ পর্যায়ে হাজি শরীয়ত উল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন। মূলত ফরায়েজি আন্দোলন হলো একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯ শতকের প্রথম দিকে এটি সূচিত হয়েছিল। ফরায়েজি আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে সূচিত হলেও পরবর্তীতে কৃষকদের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। পরবর্তীতে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, নাচোলে ইলা মিত্রের বিদ্রোহ, চট্টগ্রামে মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের  অংশ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন। এসব আন্দোলনের ধারবাহিকতায় ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে রাজপথে নেমে আসে দেশের ছাত্রসমাজ। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রক্তের বিনিময়ে অবশেষে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলার অধিকার অর্জন করি।

পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনের নামে এদেশের সম্পদ সে দেশে পাচার, লুণ্ঠন, শোষণ, নিপীড়ন নির্যাতন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে বীর বাঙালি। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে এসে স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র কতিপয় উচ্চ বিলাসী এবং বিপথগামী সেনা সদস্য সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। দীর্ঘ ২১ বছর দেশ শাসন করেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও স্বৈরাচার।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এখন শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় দ্রুত এগুচ্ছে। কিন্তু যে বৈষম্যের কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার লক্ষ্য ধনী-গরিবের বৈষম্য নিরসন এখনো সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান শাসনামলে এদেশে ২৪ কোটি পতি পরিবারের স্থলে এখন প্রায় লক্ষাধিক কোটি পতি পরিবার সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য।

এদিকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অর্জন সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর যেখানে শুধু ভাত ও রুটির ওপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। পাঁচ দশকের ব্যবধানে সেখানে  মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি ও ফলমূল উৎপাদনেও রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সবমিলিয়ে খাদ্যে অর্জন করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এ কারণে দেশ একটু একটু করে পৌঁছে গেছে সমৃদ্ধির সোপানে। সেই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, স্যানিটেশনসহ অনেক সূচকে ৫৩ বছর বয়সে বহুদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু অভ্যন্তরেই নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলেও সুনাম কুড়াচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন বিশ্ববাজারে অধিক সমাদৃত। ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। এক সময়ের ভুখা, দরিদ্র বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তবে অদক্ষতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবে বেড়েছে ধরী-গরিবের বৈষম্য। ধনীরাই দিন দিন ধনী হচ্ছেন। আর গরিবরা হচ্ছে অতি গরিব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বিদায় অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০ টাকা, যা আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ টাকা। শুধু তাই নয় দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও গড়ে বেশি আয় করেন। মাথাপিছু এ আয়ের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়েছে দেশ। অথচ দুই দশক আগেও ভারত ও পাকিস্তান বেশ এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যেই মাথাপিছু জিডিপিতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শক্তির দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অনন্য মডেল বাংলাদেশ।

হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং-টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কম পক্ষে ১৬ ধাপে উন্নীত হবে। যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এইচএসবিসির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন মডেলে দেখানো হয়েছে, ২০৩০ পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যা রিপোর্টে উল্লিখিত ৭৫টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৭ শতাংশ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে  দেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০৩০ সালে পৌঁছাবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে।

এখন সময় এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সামনে দেশকে সোনার বাংলা তৈরি করার। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য।’ আরেক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদের সঙ্গে কোনোদিন এক হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন শোষণহীন, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে তারই সুযোগ্য কন্যা দেশকে এগিয়ে নেয়ার মহতী প্রয়াস অব্যাহত রাখবেন এ প্রত্যাশা থাকল।

নিউজ লাইট ৭১