বিদায় বছরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ
- আপডেট টাইম : ০৫:৩৬:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯
- / 94
নিউজ লাইট ৭১ রিপোর্ট: ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিদায় বছরে কিছু হতাশার মাঝেও অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বছর শেষে সাউথ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস-২০১৯) সর্বাধিক স্বর্ণপদক জয়ের রেকর্ড গড়ে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ।
এ আসরে আরচারিতে দশে দশ আর উভয় বিভাগে সোনার পদক জয়ে লাল-সবুজ পতাকাকে সম্মানিত করেছে দেশের তীরন্দাজ ও ক্রিকেটাররা।
যদিও এ আসরে এবার ফুটবল, শ্যুটিং, সাঁতার, ভলিবলের ফলাফল ছিলো হতাশার। অন্যদিকে বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বেশকিছু নামিদামি ও জনপ্রিয় ক্লাব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ক্যাসিনো ঝড়ে।
ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ফকিরেরপুল ইয়াংম্যান্স ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাব, কলাবাগান ক্রীড়া সংঘ অন্যতম। ক্যাসিনো মামলার কারণে অভিযুক্ত ক্লাবগুলোতে ঝুলছে তালা। ফলে নানা কারণে ওই ক্লাবগুলোর চলমান টুর্নামেন্ট ও ঘরোয়া লিগে অংশগ্রহণ হয়ে পড়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর।
এদিকে, বিদায় বছরে আরো একটি আলোচিত ঘটনা ছিলো আইসিসি কর্তৃক বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি। সব ধরণের ক্রিকেট থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন সাকিব।
আইসিসিরি দুর্নীতি-বিরোধী নিয়ম বা অ্যান্টি করাপশন কোড লংঘনের তিনটি অভিযোগ সাকিব আল হাসান স্বীকার করে নেয়ার পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানায় সংস্থাটি।
এর ফলে ভারত সফরের আগে অনেকটাই এলোমেলো হয়ে পরেছিল বিসিবির ক্রিকেট স্কোয়াড। পরে অবশ্য বিষয়টি সামলে নেয় বিসিবি।
আইসিসি জানিয়েছে, আগামী এক বছর সাকিব খেলতে পারবেন না, কিন্তু তিনি যদি সাজার সব শর্ত মেনে চলেন তাহলে তিনি ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে মাঠে ফিরে আসতে পারবেন।
অন্যদিকে, বিদায়ী বছরে বিভিন্ন খেলাধুলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সফলতা অব্যাহত ছিলো। বছরের শেষভাগে কোলকাতার ইডেন গার্ডেনে গোলাপি বলে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো দিবা-রাত্রি টেস্টে অংশ নিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রইলো বেঙ্গল টাইগাররা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঠে সরাসরি উপস্থিত থেকে উভয়দলের খেলোড়ারদের উৎসাহ প্রদান করেন। গোলাপি টেস্টে টাইগাররা হতাশাজনক ফলাফল করলেও সেদিনের ঘটনাটি বিদায়ী বছরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
অপরদিকে ফিরে দেখা বছরে (২০১৯) বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে সবচেয়ে বড় সুখের ও আনন্দের সংবাদটি দেয় তীরন্দাজ রোমান সানা।
তিনি এই প্রথমবারের মতো ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার সুযোগ লাভ করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে। এটা যেমন আরচারি ফেডারেশন, তেমনি দেশবাসীর জন্য দারুন খবর ছিলো।
গত জুনে ওয়ার্ল্ড আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে দক্ষিণ কোরিয়া- নেদারল্যান্ডসের অলিম্পিক পদকজয়ীদের হারিয়ে পাওয়া আত্মবিশ্বাস যেন বদলে দিয়েছে এই রোমান সানাকে।
ওই মিটে রুপাজয়ী এই তীরন্দাজের পারফরম্যান্স ছিলো রূপকথার গল্পের মতো। বিশ্ব আরচারির সেরাদের হারিয়েই পেয়েছেন আসন্ন টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার সুযোগ বাংলাদেশের এই তীরন্দাজ। এটাই তার ছোট্ট ক্যারিয়ারে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিলো।
অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের যেকোনো ক্রীড়াবিদের সেরা অর্জন। এর আগে গলফার সিদ্দিকুর রহমান ২০১৬ রিও অলিম্পিকে কোটায় খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন।
বিশ্ব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপের চতুর্থ রাউন্ডে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন কিম ও-জিনকে হারিয়ে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন তিনি।
এছাড়াও বিদায় বছরে বাংলাদেশের মাটিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুর্ধ্ব-১৬ আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডশিপ ফুটবল টুর্নামেন্টে কম্বোডিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়।
অন্যদিকে, দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক রেটিং দাবায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়, বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা হকি দল সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বেশ কটি ম্যাচে জয় পেয়ে চমক দেখায়।
বিদায় বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সফলতা ছিলো সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমসে। নেপালে অনুষ্ঠিতব্য ১৩তম এসএ গেমসটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জন্য।
কারণ আগে ইতিহাসে এত বড় সাফল্য পায়নি লাল সবুজ জার্সিধারীরা। রীতিমতো ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকলো এ আসরটি। ১৯ স্বর্ণ জিতে ছাড়িয়ে গেছে নিজেদের বিগত দিনের সকল অর্জনকে।
বিদায় বছরে এসএ গেমস থেকে ১৯ স্বর্ণ, ৩৩ রৌপ্য ও ৯০টি ব্রোঞ্জসহ ১৪২টি পদক জিতে। প্রথমবারের মতো পদকের সেঞ্চুরি করায় অর্জনের খাতাটা এবার অনেক উঁচুতে উঠলো বাংলাদেশ।
এবারের গেমসে স্বর্ণ জয়ের শুরুটা হয় রাঙামাটির ছেলে দিপু চাকমার হাত ধরে। এরপর নবম দিনে এসে ১৯টি স্বর্ণ জয়ের গল্প লিগে নতুন উচ্চতায় উঠলো বাংলাদেশ। এসএ গেমসের ইতিহাসে এবারই রেকর্ড সর্বোচ্চ স্বর্ণ জিতলো বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা।
এর আগে ২০১০ সালে দেশের মাটিতে আয়োজিত এই আসরে ১৮টি স্বর্ণ জিতেছিল বাংলাদেশ। দেশের বাইরে নিজেদের ইতিহাসে এত স্বর্ণ জয় এবারই প্রথম।
এর আগে বিদেশের মাটিতে ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ এসএ গেমসে ৭টি স্বর্ণ জিতেছিল বাংলাদেশ। সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া দেয় বাংলাদেশের আরচারির দলগুলো। এক অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে মার্টিন ফ্রেডরিখের শীষ্যরা।
অন্যদিকে, ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৭ উইকেটে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে ১৯তম স্বর্ণ জয়ের নতুন চূড়ায় ওঠে বাংলাদেশ। মেয়েদের ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে স্বর্ণ জিতে নেয় বাংলাদেশ।
এর আগে ভারোত্তলনে দুটি সোনার পদক জেতার রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশকে সপ্তম স্বর্ণ পদক পাইয়ে দেন ফাতেমা মুজিব। ফেন্সিংয়ে ব্যক্তিগত সেভার ইভেন্টে তিনি সোনার পদক জিতেছেন। মাবিয়া আক্তার সীমান্তের পর বাংলাদেশ আরও একটি স্বর্ণ পদক জেতে।
বাংলাদেশকে ষষ্ঠ স্বর্ণ পদক পাইয়ে দেন জিয়ারুল ইসলাম। ৯৬ কেজি ওজন শ্রেণীতে তিনি স্বর্ণ জিতেছিলেন। মাইনুল ইসলাম ১০২ কেজিতে জিতেছেন রৌপ্য পদক।
গতবারের মতো এবারও বাংলাদেশকে সোনার পদক পাইয়ে দিয়েছেন সীমান্ত। ৭৬ কেজি ওজন শ্রেণীতে স্বর্ণ জিতেছেন তিনি। বাংলাদেশকে প্রথম পদক এনে দিয়েছিলেন হুমায়রা আক্তার অন্তরা। তবে সেটি ছিলো ব্রোঞ্জ।
তায়কোয়ান্দোতে এবার বাংলাদেশ প্রথম সোনার পদক জেতে। দিপু চাকমা পাইয়ে দেন প্রথম স্বর্ণ।তায়কোয়ান্দোতে ছেলেদের এককে পুমসায় ২৯ অথবা এর বেশি ওজনে ভারতের প্রতিযোগীকে হারিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম সোনা জেতান রাঙামাটির ছেলে দিপু।
এরপর কারাতে কুমিতে সোনা জেতেন আল আমিন। সেটি ছিলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় সোনার পদক।
এরপর কারাতে ইভেন্টের ৬০ কেজি ওজন শ্রেণী কুমিতে সোনা পাইয়ে দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আল আমিন। দেশের তৃতীয় স্বর্ণ জেতেন বাংলাদেশের আরেক খেলোয়াড় মারজানা আক্তার প্রিয়া।
এসএ গেমসে দেশের পক্ষে তৃতীয় সোনার পদক আসে মেয়েদের কারাতে ইভেন্টে। মেয়েদের অনূর্ধ্ব-৫৫ কেজি কুমি ইভেন্টে সোনা জেতেন মারজানা। বাংলাদেশকে এবার প্রথম পদক পাইয়ে দেওয়া হুমায়রা আক্তার অন্তরা বাংলাদেশকে চতুর্থ সোনার পদক পাইয়ে দেন। কারাতে ৬১ কেজি কুমিতে স্বর্ণ জেতেন অন্তরা। নেপালের অনু গুরুংকে ৫-২ পয়েন্টে হারান তিনি।
এরপর চারদিন বিরতি দিয়ে আবারও সোনার মুখ দেখে বাংলাদেশ। দেশকে পঞ্চম স্বর্ণ পাইয়ে দিয়েছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। পরে ষষ্ঠ স্বর্ণ আসে জিয়ারুল ইসলামের হাত ধরে। এবার ফাতেমা জেতান সপ্তম স্বর্ণ পদক।
ছেলেদের ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কাকে ৭ উইকেটে হারিয়ে সেরা সাফল্য আনে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল। মেয়েদের ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কাকে রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে ২ রানে হারিয়ে গেমসের অষ্টম দিনে সোনা আনে সালমারা।
এদিকে ব্যক্তিগত ইভেন্ট থেকে যেখানে নারী ক্রীড়াবিদদের হাত ধরে বাংলাদেশ পেয়েছে ৬টি স্বর্ণ পদক, সেখানে পুরুষরা জিতেছেন ৫ সোনা। ছেলেদের হয়ে পাঁচ ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ীরা হলেন- তায়কোয়ান্ডোর দিপু চাকমা, কারাতেকা আল- আমিন ইসলাম, ভারোত্তলক জিয়ারুল ইসলাম, আরচারে রোমান সানা ও মো. সোহেল রানা।
আর ব্যক্তিগত ইভেন্টে ছয় স্বর্ণজয়ী নারী হচ্ছেন- কারাতেকা মারজান আক্তার প্রিয়া, হুমায়রা আক্তার অন্তরা, ফেন্সিংয়ের ফাতেমা মুজিব, আরচারে ইতি খাতুন, সোমা বিশ্বাস ও ভারোত্তলক মাবিয়া আক্তার সিমান্ত।
দেশে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। শুধু তাই, এসএ গেমসের আগের আসরে ২০১৬ সালে গৌহাটি-শিলংয়ে বাংলাদেশ যে চারটি স্বর্ণপদক জয় করেছিল তার তিনটিই এসেছিল মেয়েদের হাত ধরেই।
তবে বড় সাফল্যের মধ্যে হতাশ করেছে পাঁচটি ফেডারেশন। আর পদকবিহীন বেশির ভাগ ফেডারেশনের দায়িত্বে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসেসিয়েশনের (বিওএ) কর্মকর্তারা। এসএ গেমসে বাংলাদেশ ২৫ ডিসিপ্লিনে অংশ নিয়ে রেকর্ড ১৯টি সোনা জিতেছে। রুপা জিতেছে ৩৩টি, ব্রোঞ্জ ৯০টি।
সব মিলিয়ে ১৪২টি পদক জিতেছে বাংলাদেশ। ১৯টি সোনার মধ্যে আরচারি থেকেই এসেছে ১০টি। কারাতে থেকে এসেছে ৩টি। ভারোত্তলন ও ক্রিকেটে দুটি করে। ফেন্সিং ও তায়কোয়ানন্দো থেকে এসেছে একটি করে সোনা।
এবারের আসরে অংশ নেয়া ২৫ ফেডারেশনের মধ্যে ভলিবল, বাস্কেটবল, সাইক্লিং, টেনিস ও স্কোয়াশ থেকে কোনো পদক জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে কাবাডি, হ্যান্ডবলে পারফরমেন্সের অবনতি ঘটেছে।