এতিমখানার টাকা হাতিয়ে অর্থের পাহাড় গড়েছেন
- আপডেট টাইম : ০৪:২৯:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২
- / 28
নরসিংদীতে মাধবদী দারুল উলুম ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানার মুহতামিম মো. ইয়াহিয়া দেওয়ানের বিরুদ্ধে এতিমখানার বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে সরেজমিনে গেলে মাধবদী বাজার বড় মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসা কয়েক শতাধিক মুসল্লি ও এলাকাবাসী তার বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি স্বোচ্চাচারিতা ও এতিমখানার অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে মুখ খুলেন। তারা জানান, মাধবদী বাজার বড় মসজিদের প্রয়াত পেশ ইমাম হাবিবুল্লাহ দেওয়ান আমৃত্যু সুনাম ও বিশ্বস্ততার সাথে মাধবদী বাজার বড় মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি এতিমখানার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তার হাত ধরেই তার বড় ছেলে ইয়াহিয়া দেওয়ান মাধবদী দারুল উলুম ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানায় শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তার পিতার মৃত্যুর পর পিতার সততায় মাদরাসা কমিটি ইয়াহিয়া দেওয়ানকে মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তিনি তার পিতার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেননি।
মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি মাদরাসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। এতিমখানার অর্থ আত্মসাত, এতিম ছাত্রদের পড়ালেখার জায়গায় দোকানের জন্য ভাড়া দেওয়া, দোকানীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ছাত্রদের ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা না করা, পরিচালনা কমিটির কাছে আয়-ব্যয়ের হিসেব না দেওয়া, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে অশোভন আচরণ করা সহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার খ্যাত বাবুরহাটের প্রাণকেন্দ্র মাধবদী বাজারে এতিমখানাটির অবস্থান।
এখানে প্রতি মাসে এতিম ছাত্রদের লেখাপড়া ও খাওয়া বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ মাধবদী বাজারের ব্যবসায়ী ও সর্বস্তরের মানুষ অনুদান প্রদান করে থাকেন। তাছাড়া মাদরাসা পরিচালনার জন্য মাদরাসা মার্কেট থেকে বৎসরে ৭০/৮০ লক্ষ টাকা ভাড়া আসে। ১৭/১৮ জন এতিম ছাত্রদের লেখাপড়া ও খাওয়া বাবদ এত টাকা আয় হওয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত ঘাটতি দেখানো হয়। এ ব্যাপারে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মুহতামিমের কাছে হিসেব চাইলে তিনি তালবাহানা শুরু করে। এ নিয়ে অনেক বার চেষ্টা করলেও বিগত কয়েক বছর ধরে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির নিকট মাদরাসা ও এতিমখানার আয়-ব্যায়ের কোন ধরনের হিসাব নিকাশ না দিয়ে মুহতামিম ইয়াহিয়া দেওয়ান তার নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে।
ফলে এতিমখানা ও মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তার কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে বিগত চার বছর পূর্বে স্বেচ্ছায় কমিটি থেকে অব্যাহতি নেন।
এতে করে মাঠ ফাঁকা পেয়ে সে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বহুতল ভবন, বাড়ি-গাড়ি ও কয়েক শতাধিক বিঘা জমি সহ বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের মালিক বনে যান।
মাধবদী বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমান উল্লাহ আমান বলেন, মাধবদী তথা এর আশপাশ এলাকার এতিম ও অসহায় পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বিশিষ্ট দানবীর মরহুম আম্বর আলী প্রধান বাংলা ১৩৫৯ সালে ‘মাধবদী দারুল উলুম ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা ‘নামে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব সম্পত্তির উপর চালু করেন। চালুর পর থেকে অত্যন্ত সুনামের সাথে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর ও বেশী সময় ধরে মাদরাসাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মসজিদ-মাদরাসাসহ অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে এ মাদরাসার ছাত্ররা সুনামের সাথে ইমামতি ও শিক্ষকতা করে আসছে।
তিনি আরও বলেন, ইয়াহিয়া দেওয়ান মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাদরাসার শিক্ষাসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি শুরু হয়। কিছুদিন ধরে মাদরাসার দ্বিতীয় তলার হেফজ খানার ছাত্রদের পড়ালেখার স্থান ব্যাবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে চতুর্থ তলায় টিন দিয়ে তাদের পড়ালেখা ও থাকার ব্যাবস্থা করার পাঁয়তারা চলছে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। মাদরাসার এত অনুদান ও দোকান ভাড়ার টাকা থাকা সত্ত্বেও কার স্বার্থে ইয়াহিয়া ছাত্রদের পড়ালেখার জায়গা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেয়? আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
মো. ইলিয়াস বলেন, মাদরাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চতুর্থ তলায় স্থানান্তর করে দোতলা ভাড়া দেওয়ার যে চক্রান্ত চলছে এলাকার একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
মাধবদী তথা নরসিংদী জেলার সবচেয়ে স্বণামধন্য ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাধবদী দারুল উলুম ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার হারানো গৌরব ফিরে পেতে ইয়াহিয়া দেওয়ানের মতো দুষ্কৃতকারীদের মাদরাসা থেকে বিতাড়িত করাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
হাজী মোহাম্মদ রোম্মান বলেন, মাদরাসার কয়েকজন ছাত্রের খরচ বহন করার সুবাদে জাপান থেকে দেশে আসার পর বিগত দুই বৎসর ধরে এখানে আমার যাতায়াত। দুই-তিনদিন পূর্বে হঠাৎ দেখি মাদরাসার দ্বিতীয় তলা ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ছোট্ট শিশুদেরকে চতুর্থ তলায় টিন দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করে সেখানে স্থানান্তর করে দোতলা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সামনে গরমের দিন আসছে। এই প্রচন্ড গরমে ছোট্ট শিশুরা কিভাবে এই টিনের ঘরে থাকবে? গত আগস্ট মাসে ঢাকার ফতুল্লায় টিনের ঘরে প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে একটি শিশু মারা গেছে! এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও মুহতামিম এককভাবে কিভাবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তা আমার জানা নেই।
মাদরাসার সার্বিক শিক্ষার পরিবেশ ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দোতলা ভাড়া না দিয়ে পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে মাদ্রাসা পরিচালনা পরিষদ ও মাধবদী পৌর মেয়রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদরাসার একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, একটি মাদরাসার উন্নয়নের জন্য একজন উপযুক্ত মুহতামিম দরকার। এখানে মুহতামিম হিসেবে যে অযোগ্য ব্যাক্তিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে তিনি সর্বদা নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। তার কাছে শিক্ষা এবং ছাত্রদের কোনো মূল্য নেই। তিনি নিজে ছাড়া অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্রদের মানুষ হিসেবে গন্যই করে না। আমরা তার পদত্যাগ সহ দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
মাধবদী বাজার বড় মসজিদের সেক্রেটারি মো. আবুবকর সিদ্দিক বলেন, বিগত চার বছর ধরে মাদরাসার কোনো কমিটি নেই। এ সুবাদে মুহতামিম ইয়াহিয়া দেওয়ান তেমন খুশি তেমন করে লুটপাট করে মাদরাসাটি খেয়ে শেষ করে ফেলছে। এখানে কোনো সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নেই। মাদ্রাসার আয়ের কোন টাকাই ইয়াহিয়া ক্যাশিয়ারের কাছে দেয় না। সে যেভাবে খুশি তা খরচ করে, কাউকে হিসেব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। আমরা তার বিচার চাই।
মাধবদী পৌর মেয়র হাজী মোশাররফ হোসেন প্রধান মানিক বলেন, আমরা ছোটকাল থেকেই এ মাদরাসা দেখে আসছি। দীর্ঘদিন ধরে এ মাদ্রাসার মুহতামিম ইয়াহিয়া দেওয়ান এর আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব দিচ্ছে না।
মাদরাসায় শিক্ষকতা করে এ মাদরাসার মুহতামিম ইয়াহিয়া দেওয়ান কিভাবে ঢাকা বাড়ি গাড়িসহ হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক হয় এ হিসেব আমাদেরকে দিতে হবে। আমি মাধবদী পৌর মেয়র হিসেবে অচিরেই আপনাদেরকে সাথে নিয়ে মাদ্রাসার একটি পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে সঠিক হিসেব বুঝে নিব।
এ ব্যাপারে জানতে মাদরাসার মুহতামিম ইয়াহিয়া দেওয়ানের কাছে গেলে তিনি তার উপর আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছাত্রদের পড়ালেখার স্থান ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই। মাদরাসার উপদেষ্টা সাফি উদ্দিন চেয়ারম্যান আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন আমি সেভাবেই কাজ করছি।
মাদরাসার অর্থ লোপাট করে বাড়ি-গাড়ি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা সবাই চোর। মাধবদীর খিলগাঁও এলাকায় আমার ৪০/৫০ বিঘা জমি কেনা আছে।
বর্তমানে সেই জমি থেকে ১০/১২ বিঘা জমি ৩০/৪০ লক্ষ টাকা দরে বিক্রি করে সেই টাকা থেকেই বাড়ি গাড়ি করছি। আপনি শিক্ষকতা করে এত সম্পদ কিভাবে কিনলেন জানতে চাইলে তিনি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
মাধবদী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও মাধবদী দারুল উলুম ইসলামিয়া হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানার উপদেষ্টা সফিউদ্দিন আহমেদ সাফি বলেন, মাদরাসার আয়-ব্যয়ের কোনো হিসেব আমার কাছে নেই। মাদরাসার মুহতামিম ইয়াহিয়া আমাকে বলেছে যে পরিমাণ ভাড়া ও অনুদান আসে তা দিয়ে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের খরচ ঠিক মতো চলে না। দোতলায় ছাত্রদের পড়ার জায়গাটি মার্কেটের জন্য ভাড়া দিয়ে ছাত্রদের জন্য চতুর্থ তলায় ব্যাবস্থা করে দিলে অনেকটা সাশ্রয় হবে। মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে তিনি তাকে যেভাবে মাদরাসার ছাত্রদের ভালো হয় সেভাবে কাজ করার কথা বলে দিয়েছেন।
নিউজ লাইট ৭১