ঢাকা ১০:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আদালতে নির্বিকার সু চি

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৯:২৪:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯
  • / 94

নিউজ লাইট ৭১ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের যা যা করার দরকার সবই করেছেন —দাবি পররাষ্ট্র সচিবের
জীবন্ত রোহিঙ্গাদের কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি গতকাল হেগের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে শুরু হয়েছে।

আজ মিয়ানমারের যুক্তিখণ্ডন, আগামীকাল গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের চূড়ান্ত শুনানি করা হবে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) যেকোনো রায়ই চূড়ান্ত, নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকতে হবে।

চূড়ান্ত রায়ের পর আপিলেরও কোনো সুযোগ থাকবে না। আগামীকাল পক্ষে রায় এলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে উৎসাহী হবে। এ শুনানিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ তথ্য দিয়ে নেপথ্যে কাজ করছে। বিচার পর্যবেক্ষণে পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ২০ সদস্যের টিম নেদাল্যান্ডসে রয়েছেন।

হেগের শুনানিকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাসহ বিশ্ব মানবতাবাদীরা অং সাং সু চির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করেছেন। তবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় এখনো অনুতপ্ত না হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতকেও এবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে মিয়ানমার।

গতকাল যখন সু চি আদালতে বসা ঠিক সেই সময়ে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত ইয়াঙ্গুনে সু চির সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করে। সু চির মর্যাদা রক্ষায় সর্বাবস্থায় তার সঙ্গে মিয়ানমার থাকবে বলে এমন ঘোষণা দিয়ে স্লোগান দেয়া হয়েছে।

তবে মিয়ানমারের সেনা কর্তৃক যে অসহায় শিশু-নারীদের হত্যা করা হয়েছে, বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, গণহত্যার এমন বর্ণনা সু চির সামনেই আইসিজেকে শোনালো গাম্বিয়া।

আদালতকে দেশটি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে, দিনের পর দিন অভুক্ত রাখা হয়েছে, এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসাবে সনদের লঙ্ঘন।

মিয়ানমারে এমন গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে আদালতকে অনুরোধ করা হয়েছে। আরাকানে এখনো যে ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রোপাগাণ্ডার কথাও তুলে ধরা হয়।

ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে, সেটির নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তর থেকে। গতকাল গাম্বিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি অভিজ্ঞ। তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডসসহ বিশ্ব পরিসরে নেতৃস্থানীয় আইনজ্ঞরাও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ এবং কানাডার প্রতিনিধিরা শুনানির সময় পিস প্যালেসে ছিলেন। বাংলাদেশ-কানাডার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস নেপথ্যে থেকে গাম্বিয়াকে সহযোগিতা করছে।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, মিয়ারমারের বিরুদ্ধে অভিযোগটা এনেছে গাম্বিয়া। সুতরাং আদালতের মুখোমুখি হয়েছে গাম্বিয়া। এ বিষয়ে বাংলাদেশের যা যা করার দরকার সবই করেছে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

দেশের ভেতরে ও বাইরে লিগেল অপিনিয়ন নেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, এটা একটা হিস্টরিক প্রসেজ। রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে সহজ হবে তবে একটু সময় লাগবে। আমরা আশা করছি রায়টা রোহিঙ্গাদের পক্ষে যাবে।

মিয়ানমার বাংলাদেশের সাবেক কূটনৈতিক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে আমাদের যেমন দৃষ্টি রয়েছে তেমনিভাবে রোহিঙ্গাদের আশু প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ সেগুলোর দিকেও আমাদের সব সময় দৃষ্টি থাকতে হবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারক আব্দুলকায়ি আহমেদ ইউসুফ অভিযোগ পড়ে শোনান। এরপর রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক পায়াম আখাভান।

তিনি জানান, কীভাবে মিয়ানমার সেনারা রাখাইনে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের পুরো দেশ থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ও নিপীড়ন চালানো হয় তাও উঠে আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রোপাগাণ্ডার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

মার্কিন আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো আদালতের কাছে আরাকানে এখনো যে ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধি-নিষেধের কথা যা জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে সেগুলোর বিবরণ দেন তিনি।

তাফাদজ পাসিপান্দো বলেন, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের অভুক্ত রাখা। এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসাবে সনদের লঙ্ঘন।

আরও গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে এই আদালত। বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এরপর তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।

গাম্বিয়ার পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রফেসর স্যান্ডিস বলেন, গণহত্যার বিচারের জন্য এই আদালত সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। সবাই মামলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মিয়ানমার গণহত্যার বিষয়ে কখনোই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি জানান, গাম্বিয়া আদালতের কাছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ছয়টি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চায়।

যেগুলোর মধ্যে রয়েছে, আর যেন গণহত্যার মতো ঘটনা মিয়ানমারে না ঘটে তা নিশ্চিত করা, আগের গণহত্যার আলামত নষ্ট না করা, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার সরকার উভয়পক্ষকে শান্ত থাকা এবং উত্তেজনা প্রশমনে সাহায্য করা। এছাড়া, মিয়ানমার জাতিসংঘকে তদন্তের ব্যাপারে সাহায্য করবে এই নিশ্চয়তাও চায় গাম্বিয়া।

গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু বলেছেন, আধুনিক যুগে এই গণহত্যা কোনোভাবেই গ্রহণ করা যায় না। রোহিঙ্গারাও মানুষ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ বাঁচার অধিকার তাদের রয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুদের অধিকার রয়েছে শিক্ষা লাভ করে ডাক্তার হওয়ার।

তিনি বলেন, আমি ২০১৮ সালে কক্সবাজারে ওআইসির পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করি। সেখানে গিয়ে রোহিঙ্গাদের চোখে ভয়, কষ্ট ও মানবিকতার চরম অবমাননা দেখতে পেয়েছি। সেখানে গিয়েই জানতে পেরেছি রাখাইনে গণহত্যা চালানো হয়েছে। গণহত্যা না হলে এত মানুষ পালিয়ে আসত না।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের বিচারকদের মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের চলমান গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, গাম্বিয়া যা চায় তা হলো আপনি মিয়ানমারকে এই নির্বোধ হত্যা বন্ধ করতে বলুন।

এই বর্বরতা ও নৃশংসতার কাজগুলো বিশ্বকে হতবাক করেছে এবং আমাদের সম্মিলিত বিবেককে আজীবন আঘাত করতে থাকবে। তাই এখনি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।

এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচারপতি কমিশনার রিড ব্রোডি উপস্থিত গণমাধ্যমকে বলেছেন, অং সান সু চির মতো শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পক্ষে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়া সম্পূর্ণ নজিরবিহীন। আইনগতভাবে সু চির পক্ষে এ রকম একটি ভূমিকা গ্রহণ করা তার পক্ষে প্রতিকূল হতে পারে।

কারণ, দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এই মামলাটি নিয়ে রাজনীতি করছেন। আইসিজে ঐতিহ্য এবং কূটনৈতিক প্রোটোকলকে সমর্থন করে এবং আমি সন্দেহ করি যে, মিয়ানমার থেকে সরকারকে সমর্থন দেয়ার জন্য সফরকারী দলগুলো বিচারকরা প্রভাবিত করবে।

নির্বিকার সু চি : আদালত কক্ষে গাম্বিয়ার আইনজীবী দলের সদস্যরা যখন মিয়ানমারের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেন তখন নির্বিকার দেখা যায় অং সান সু চিকে।

তবে একই সময়ে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত ইয়াঙ্গুনে সু চির সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করে। সমাবেশে আসা বার্মিজদের হাতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। অনেকেই ‘দেশের মর্যাদা রক্ষায়’,‘জননী সু চির পাশে দাঁড়ান’ স্লোগান দেন।

দেশীয় পোশাক পরে আদালতে সু চি : মিয়ানমারের দেশীয় পোশাক পরে আদালতে আসেন সু চি। তবে তিনি আদালতে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলেননি। এ সময় তার সাথে ছিলেন নেদারল্যান্ডে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা।

হেগে ছিলেন যেসব বিচারকরা : এই আদালতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন সোমালিয়ার বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট চীনের বিচারপতি ঝু হানকিন। বিচারকদের নির্বাচন করেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ।

অন্য সদস্যরা হলেন স্লোভাকিয়ার বিচারপতি পিটার টমকা, ফ্রান্সের বিচারপতি রনি আব্রাহাম, মরক্কোর মোহাম্মদ বেনুনা, ব্রাজিলের অ্যান্টোনিও অগাস্টো কানকাডো ত্রিনাদে, যুক্তরাষ্ট্রের জোয়ান ই ডনোহু, ইতালির গর্জিও গাজা, উগান্ডার জুলিয়া সেবুটিন্দে, ভারতের দলভির ভান্ডারি, জ্যামাইকার প্যাট্রিক লিপটন রবিনসন, অস্ট্রেলিয়ার রির্চাড ক্রর্ফোড, রাশিয়ার কিরিল গিভরগিয়ান, লেবাননের নওয়াফ সালাম এবং জাপানের ইউজি ইওয়াসাওয়া।

গাম্বিয়ার স্লোগানে মুখরিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প : গাম্বিয়া গাম্বিয়া স্লোগানে মুখর ছিলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। পশ্চিম আফ্রিকার এ দেশটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করেছে।

গতকাল মঙ্গলবার ১০ নভেম্বর এ ইস্যুতে আদালতে শুনানি হয়। এর প্রেক্ষিতে সকালে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইসিজে গণহত্যার বিচারের আগে ‘গাম্বিয়া, গাম্বিয়া’ স্লোগানে মুখর করে তোলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। সাইফুর রহমান নামে এক ব্যক্তি তার টুইটে এ স্লোগানের একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছেন।

Tag :

শেয়ার করুন

আদালতে নির্বিকার সু চি

আপডেট টাইম : ০৯:২৪:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

নিউজ লাইট ৭১ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের যা যা করার দরকার সবই করেছেন —দাবি পররাষ্ট্র সচিবের
জীবন্ত রোহিঙ্গাদের কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি গতকাল হেগের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে শুরু হয়েছে।

আজ মিয়ানমারের যুক্তিখণ্ডন, আগামীকাল গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের চূড়ান্ত শুনানি করা হবে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) যেকোনো রায়ই চূড়ান্ত, নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকতে হবে।

চূড়ান্ত রায়ের পর আপিলেরও কোনো সুযোগ থাকবে না। আগামীকাল পক্ষে রায় এলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে উৎসাহী হবে। এ শুনানিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ তথ্য দিয়ে নেপথ্যে কাজ করছে। বিচার পর্যবেক্ষণে পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ২০ সদস্যের টিম নেদাল্যান্ডসে রয়েছেন।

হেগের শুনানিকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাসহ বিশ্ব মানবতাবাদীরা অং সাং সু চির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করেছেন। তবে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় এখনো অনুতপ্ত না হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতকেও এবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে মিয়ানমার।

গতকাল যখন সু চি আদালতে বসা ঠিক সেই সময়ে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত ইয়াঙ্গুনে সু চির সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করে। সু চির মর্যাদা রক্ষায় সর্বাবস্থায় তার সঙ্গে মিয়ানমার থাকবে বলে এমন ঘোষণা দিয়ে স্লোগান দেয়া হয়েছে।

তবে মিয়ানমারের সেনা কর্তৃক যে অসহায় শিশু-নারীদের হত্যা করা হয়েছে, বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, গণহত্যার এমন বর্ণনা সু চির সামনেই আইসিজেকে শোনালো গাম্বিয়া।

আদালতকে দেশটি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে, দিনের পর দিন অভুক্ত রাখা হয়েছে, এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসাবে সনদের লঙ্ঘন।

মিয়ানমারে এমন গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে আদালতকে অনুরোধ করা হয়েছে। আরাকানে এখনো যে ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রোপাগাণ্ডার কথাও তুলে ধরা হয়।

ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে, সেটির নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তর থেকে। গতকাল গাম্বিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি অভিজ্ঞ। তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডসসহ বিশ্ব পরিসরে নেতৃস্থানীয় আইনজ্ঞরাও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ এবং কানাডার প্রতিনিধিরা শুনানির সময় পিস প্যালেসে ছিলেন। বাংলাদেশ-কানাডার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস নেপথ্যে থেকে গাম্বিয়াকে সহযোগিতা করছে।

পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, মিয়ারমারের বিরুদ্ধে অভিযোগটা এনেছে গাম্বিয়া। সুতরাং আদালতের মুখোমুখি হয়েছে গাম্বিয়া। এ বিষয়ে বাংলাদেশের যা যা করার দরকার সবই করেছে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

দেশের ভেতরে ও বাইরে লিগেল অপিনিয়ন নেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, এটা একটা হিস্টরিক প্রসেজ। রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে সহজ হবে তবে একটু সময় লাগবে। আমরা আশা করছি রায়টা রোহিঙ্গাদের পক্ষে যাবে।

মিয়ানমার বাংলাদেশের সাবেক কূটনৈতিক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে আমাদের যেমন দৃষ্টি রয়েছে তেমনিভাবে রোহিঙ্গাদের আশু প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ সেগুলোর দিকেও আমাদের সব সময় দৃষ্টি থাকতে হবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারক আব্দুলকায়ি আহমেদ ইউসুফ অভিযোগ পড়ে শোনান। এরপর রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক পায়াম আখাভান।

তিনি জানান, কীভাবে মিয়ানমার সেনারা রাখাইনে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের পুরো দেশ থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় ও নিপীড়ন চালানো হয় তাও উঠে আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী প্রোপাগাণ্ডার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

মার্কিন আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো আদালতের কাছে আরাকানে এখনো যে ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাদের দুর্ভোগ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বেষ্টনীর মধ্যে শিবিরে আটক রাখা, চলাচলের স্বাধীনতা খর্ব করা ও অন্যান্য বিধি-নিষেধের কথা যা জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে সেগুলোর বিবরণ দেন তিনি।

তাফাদজ পাসিপান্দো বলেন, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, খাদ্য সরবরাহ কমানো হয়েছে, তাদের পালিত পশু কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘ তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের অভুক্ত রাখা। এগুলো গণহত্যার উদ্দেশ্য হিসাবে সনদের লঙ্ঘন।

আরও গণহত্যার অপরাধ যাতে না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে এই আদালত। বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এরপর তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।

গাম্বিয়ার পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রফেসর স্যান্ডিস বলেন, গণহত্যার বিচারের জন্য এই আদালত সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। সবাই মামলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। মিয়ানমার গণহত্যার বিষয়ে কখনোই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি জানান, গাম্বিয়া আদালতের কাছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ছয়টি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চায়।

যেগুলোর মধ্যে রয়েছে, আর যেন গণহত্যার মতো ঘটনা মিয়ানমারে না ঘটে তা নিশ্চিত করা, আগের গণহত্যার আলামত নষ্ট না করা, রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার সরকার উভয়পক্ষকে শান্ত থাকা এবং উত্তেজনা প্রশমনে সাহায্য করা। এছাড়া, মিয়ানমার জাতিসংঘকে তদন্তের ব্যাপারে সাহায্য করবে এই নিশ্চয়তাও চায় গাম্বিয়া।

গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু বলেছেন, আধুনিক যুগে এই গণহত্যা কোনোভাবেই গ্রহণ করা যায় না। রোহিঙ্গারাও মানুষ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ বাঁচার অধিকার তাদের রয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুদের অধিকার রয়েছে শিক্ষা লাভ করে ডাক্তার হওয়ার।

তিনি বলেন, আমি ২০১৮ সালে কক্সবাজারে ওআইসির পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করি। সেখানে গিয়ে রোহিঙ্গাদের চোখে ভয়, কষ্ট ও মানবিকতার চরম অবমাননা দেখতে পেয়েছি। সেখানে গিয়েই জানতে পেরেছি রাখাইনে গণহত্যা চালানো হয়েছে। গণহত্যা না হলে এত মানুষ পালিয়ে আসত না।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের বিচারকদের মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের চলমান গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, গাম্বিয়া যা চায় তা হলো আপনি মিয়ানমারকে এই নির্বোধ হত্যা বন্ধ করতে বলুন।

এই বর্বরতা ও নৃশংসতার কাজগুলো বিশ্বকে হতবাক করেছে এবং আমাদের সম্মিলিত বিবেককে আজীবন আঘাত করতে থাকবে। তাই এখনি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।

এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচারপতি কমিশনার রিড ব্রোডি উপস্থিত গণমাধ্যমকে বলেছেন, অং সান সু চির মতো শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার পক্ষে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়া সম্পূর্ণ নজিরবিহীন। আইনগতভাবে সু চির পক্ষে এ রকম একটি ভূমিকা গ্রহণ করা তার পক্ষে প্রতিকূল হতে পারে।

কারণ, দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এই মামলাটি নিয়ে রাজনীতি করছেন। আইসিজে ঐতিহ্য এবং কূটনৈতিক প্রোটোকলকে সমর্থন করে এবং আমি সন্দেহ করি যে, মিয়ানমার থেকে সরকারকে সমর্থন দেয়ার জন্য সফরকারী দলগুলো বিচারকরা প্রভাবিত করবে।

নির্বিকার সু চি : আদালত কক্ষে গাম্বিয়ার আইনজীবী দলের সদস্যরা যখন মিয়ানমারের নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেন তখন নির্বিকার দেখা যায় অং সান সু চিকে।

তবে একই সময়ে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত ইয়াঙ্গুনে সু চির সমর্থনে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করে। সমাবেশে আসা বার্মিজদের হাতে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। অনেকেই ‘দেশের মর্যাদা রক্ষায়’,‘জননী সু চির পাশে দাঁড়ান’ স্লোগান দেন।

দেশীয় পোশাক পরে আদালতে সু চি : মিয়ানমারের দেশীয় পোশাক পরে আদালতে আসেন সু চি। তবে তিনি আদালতে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলেননি। এ সময় তার সাথে ছিলেন নেদারল্যান্ডে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা।

হেগে ছিলেন যেসব বিচারকরা : এই আদালতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন সোমালিয়ার বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট চীনের বিচারপতি ঝু হানকিন। বিচারকদের নির্বাচন করেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ।

অন্য সদস্যরা হলেন স্লোভাকিয়ার বিচারপতি পিটার টমকা, ফ্রান্সের বিচারপতি রনি আব্রাহাম, মরক্কোর মোহাম্মদ বেনুনা, ব্রাজিলের অ্যান্টোনিও অগাস্টো কানকাডো ত্রিনাদে, যুক্তরাষ্ট্রের জোয়ান ই ডনোহু, ইতালির গর্জিও গাজা, উগান্ডার জুলিয়া সেবুটিন্দে, ভারতের দলভির ভান্ডারি, জ্যামাইকার প্যাট্রিক লিপটন রবিনসন, অস্ট্রেলিয়ার রির্চাড ক্রর্ফোড, রাশিয়ার কিরিল গিভরগিয়ান, লেবাননের নওয়াফ সালাম এবং জাপানের ইউজি ইওয়াসাওয়া।

গাম্বিয়ার স্লোগানে মুখরিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প : গাম্বিয়া গাম্বিয়া স্লোগানে মুখর ছিলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। পশ্চিম আফ্রিকার এ দেশটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করেছে।

গতকাল মঙ্গলবার ১০ নভেম্বর এ ইস্যুতে আদালতে শুনানি হয়। এর প্রেক্ষিতে সকালে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইসিজে গণহত্যার বিচারের আগে ‘গাম্বিয়া, গাম্বিয়া’ স্লোগানে মুখর করে তোলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। সাইফুর রহমান নামে এক ব্যক্তি তার টুইটে এ স্লোগানের একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছেন।