ঢাকা ০৩:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩৯:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • / 33

বিক্রির উদ্দেশ্যে মাটির বাসন নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বিক্রেতা (ছবি : নিউজ লাইট ৭১)

‘মৃৎ’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে নিজ হাতে তৈরি কোনো সুন্দর জিনিস। আর তাই মাটি দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রকে বলা হয় মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্প মানেই গ্রামীণ ঐতিহ্য লালন পালন করে, কথা বলে গ্রাম-বাংলার মাটি ও মানুষের। গ্রামীণ সভ্যতার বাংলাদেশে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন এই মৃৎশিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বলা হয় ‘কুমার’। গ্রামে তাদের বলা হয় ‘পাল’। বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়েই পরিচিত হয় সেই দেশ বা জাতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারের পিছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রঘুনাথপুর গ্রামে পূর্বপুরুষ থেকে অনেকেই এ মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া মৃৎশিল্পের ব্যবসা প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে যেন হার মেনেছে। দিনকে দিন এই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প তার গৌরব হারাতে বসেছে প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে। সারাদিন ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে মাটির পাত্র বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা,লোকসানটাই যেন বেশি।

মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত গ্রামের অনেকেই জানালেন, পহেলা বৈশাখ ব্যতিত আর কোনো সময় তেমন কোনো বিক্রি নেই। রঘুনাথপুর থেকে প্রতিদিন বাইক করে মাটির হাঁড়িপাতিলসহ নানা ধরনের বাসন কোসন এবং খেলার সামগ্রী তৈরি করে নিয়ে আসেন ময়মনসিংহ শহরসহ বিভিন্ন স্থানে।

স্থানীয় সুনিল পাল বলেন, যেখানে মেলা অথবা খেলা, সেখানেই সড়কের ধারে পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রি করেন। কিন্তু এখন আর তেমন বিক্রি হয় না। প্রতিদিন ৫শ থেকে ৬শ টাকা বিক্রি হয়। গাড়ি ভাড়া আর খাবার শেষে এক দুশ টাকা সঞ্চয় থাকে, যা দিয়ে অন্যান্য মৃৎশিল্পীর খোরাক দিবে না নিজ সংসার চালাবে তা নিয়ে চিন্তিত।

তিনি বলেন, মাটির হাঁড়ি, কলস, ব্যাংক, জল কান্দা, পুতুল, ফুলি, চৌকা, প্লেট, ছড়া, জগ এবং ছোটদের জন্য খেলার নানান রকম জিনিস তৈরি করা হয় কিন্তু বেচা বিক্রি নেই। প্লাস্টিক সামগ্রী এসে আমাদের এ ব্যবসাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন লাভ তো দূরের কথা, আসলও উঠতে চায় না। বাপ দাদার রেখে যাওয়া এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি, অন্য কোনো ব্যবসা খুঁজছি।

ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই পাল পরিবারের মৃৎশিল্পীরা মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিলসহ নানা ধরনের বাসন-কোসন এবং খেলার সামগ্রী তৈরি করে আসছেন। এক সময় হাজার হাজার পরিবার মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করতেন। অথচ দিনকে দিন এই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প তার গৌরব হারাতে বসেছে। প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে তাদের মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল আজ হুমকির মুখে। মৃৎশিল্পের কদর কমে যাওয়ায় পালপাড়ার প্রায় শতাধিক কারিগর পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছেন। অভাব-অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। এ কারণে অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের সন্তানদের শত কষ্টের মাঝেও লেখাপড়া করাচ্ছেন।

এভাবে কষ্ট করে তারা জীবিকা চালাচ্ছেন। তবে এসব শিল্পী চান না তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ পেশায় জড়াক। তাই অনেকেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। রং-কাদামাখা হাতগুলো এখন অনেকটাই নির্লিপ্ত। কারণ বেচা-কেনা নেই। তাদের আক্ষেপ, এখন আর কেউ মাটির প্লেটে খায় না কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত। কেউ রাঁধে না মাটির হাঁড়িতে। প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়ামের এই যুগে মাটির জিনিসের কদর কমে গেছে। প্রাচীন বাংলার হারানো ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রবল বাসনা থাকলেও ছাপোষা এসব মানুষ আর পারছেন না দরিদ্রতার কষাঘাত সহ্য করতে। তাই তো বাধ্য হচ্ছেন অন্য পেশায় যুক্ত হতে।

নিউজ লাইট ৭১

 

Tag :

শেয়ার করুন

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

আপডেট টাইম : ০৫:৩৯:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২২

‘মৃৎ’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে নিজ হাতে তৈরি কোনো সুন্দর জিনিস। আর তাই মাটি দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রকে বলা হয় মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্প মানেই গ্রামীণ ঐতিহ্য লালন পালন করে, কথা বলে গ্রাম-বাংলার মাটি ও মানুষের। গ্রামীণ সভ্যতার বাংলাদেশে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন এই মৃৎশিল্প। এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বলা হয় ‘কুমার’। গ্রামে তাদের বলা হয় ‘পাল’। বিশ্বজুড়ে প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়েই পরিচিত হয় সেই দেশ বা জাতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারের পিছনে রয়েছে একেকটি দেশ বা জাতির অবদান। তেমনই একটি শিল্প হচ্ছে মৃৎশিল্প।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রঘুনাথপুর গ্রামে পূর্বপুরুষ থেকে অনেকেই এ মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া মৃৎশিল্পের ব্যবসা প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে যেন হার মেনেছে। দিনকে দিন এই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প তার গৌরব হারাতে বসেছে প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে। সারাদিন ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে মাটির পাত্র বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা,লোকসানটাই যেন বেশি।

মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত গ্রামের অনেকেই জানালেন, পহেলা বৈশাখ ব্যতিত আর কোনো সময় তেমন কোনো বিক্রি নেই। রঘুনাথপুর থেকে প্রতিদিন বাইক করে মাটির হাঁড়িপাতিলসহ নানা ধরনের বাসন কোসন এবং খেলার সামগ্রী তৈরি করে নিয়ে আসেন ময়মনসিংহ শহরসহ বিভিন্ন স্থানে।

স্থানীয় সুনিল পাল বলেন, যেখানে মেলা অথবা খেলা, সেখানেই সড়কের ধারে পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রি করেন। কিন্তু এখন আর তেমন বিক্রি হয় না। প্রতিদিন ৫শ থেকে ৬শ টাকা বিক্রি হয়। গাড়ি ভাড়া আর খাবার শেষে এক দুশ টাকা সঞ্চয় থাকে, যা দিয়ে অন্যান্য মৃৎশিল্পীর খোরাক দিবে না নিজ সংসার চালাবে তা নিয়ে চিন্তিত।

তিনি বলেন, মাটির হাঁড়ি, কলস, ব্যাংক, জল কান্দা, পুতুল, ফুলি, চৌকা, প্লেট, ছড়া, জগ এবং ছোটদের জন্য খেলার নানান রকম জিনিস তৈরি করা হয় কিন্তু বেচা বিক্রি নেই। প্লাস্টিক সামগ্রী এসে আমাদের এ ব্যবসাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন লাভ তো দূরের কথা, আসলও উঠতে চায় না। বাপ দাদার রেখে যাওয়া এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি, অন্য কোনো ব্যবসা খুঁজছি।

ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই পাল পরিবারের মৃৎশিল্পীরা মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিলসহ নানা ধরনের বাসন-কোসন এবং খেলার সামগ্রী তৈরি করে আসছেন। এক সময় হাজার হাজার পরিবার মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে জীবন অতিবাহিত করতেন। অথচ দিনকে দিন এই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প তার গৌরব হারাতে বসেছে। প্লাস্টিক সামগ্রীর কাছে তাদের মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল আজ হুমকির মুখে। মৃৎশিল্পের কদর কমে যাওয়ায় পালপাড়ার প্রায় শতাধিক কারিগর পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছেন। অভাব-অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। এ কারণে অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের সন্তানদের শত কষ্টের মাঝেও লেখাপড়া করাচ্ছেন।

এভাবে কষ্ট করে তারা জীবিকা চালাচ্ছেন। তবে এসব শিল্পী চান না তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ পেশায় জড়াক। তাই অনেকেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। রং-কাদামাখা হাতগুলো এখন অনেকটাই নির্লিপ্ত। কারণ বেচা-কেনা নেই। তাদের আক্ষেপ, এখন আর কেউ মাটির প্লেটে খায় না কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত। কেউ রাঁধে না মাটির হাঁড়িতে। প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়ামের এই যুগে মাটির জিনিসের কদর কমে গেছে। প্রাচীন বাংলার হারানো ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রবল বাসনা থাকলেও ছাপোষা এসব মানুষ আর পারছেন না দরিদ্রতার কষাঘাত সহ্য করতে। তাই তো বাধ্য হচ্ছেন অন্য পেশায় যুক্ত হতে।

নিউজ লাইট ৭১