দুর্নীতির টাকার বেশির ভাগ যায় ফ্ল্যাট আর জমিতে
- আপডেট টাইম : ০৯:৫১:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯
- / 105
নিউজ লাইট ৭১ ডেস্ক: বাংলাদেশে প্রতি বছর দুর্নীতির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ আয়-রোজগার করা হয়, সেটার আসলে সঠিক কোনো তথ্য-উপাত্ত কারও কাছে নেই। তবে দুর্নীতি নিয়ে যেসব সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করে, তাদের ধারণা এই সংখ্যা লক্ষ কোটি টাকার কম নয়।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, বাংলাদেশে দুর্নীতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি সেবা খাতের দুর্নীতি, ঘুষ হিসাবে যেটি বর্ণনা করা যায়। এর ফলে যারা সেবা নিচ্ছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আর কর্মকর্তারা ঘুষ নিয়ে অর্থ সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন। এ রকম দুর্নীতির তথ্য বিশ্বের কোনো দেশেই থাকে না।
আরেকটি দুর্নীতি হলো রুই-কাতলা দুর্নীতি বা বড় ধরনের দুর্নীতি, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কেনাকাটা থেকে শুরু করে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, বাজেট বাস্তবায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়। সেখানে অনেকগুলো পক্ষ থাকে, যার মধ্যে রাজনৈতিক নেতারা, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী এরা জড়িত থাকেন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের সূচকে দুর্নীতির দিক থেকে শীর্ষ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম।
২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। ২০১২ সাল থেকে চালু হওয়া নতুন দুর্নীতির ধারণা সূচকের তালিকায় শীর্ষ না হলেও প্রথম বিশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম থাকছে।
কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা এসব অর্থের কী হয়? তার কতটা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয় আর কতটা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে? এসব অর্থ কি দেশের অর্থনীতিতে কোনো রকম অবদান রাখে?
কোথায় যায় এসব অর্থ : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক নাজনীন আহমেদ জানান, অবৈধভাবে উপার্জিত অবৈধ আয়ের একটি অংশ দেশের ভেতরেই থাকে, আরেকটি অংশ নানাভাবে দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়।
তিনি বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত যে টাকা-পয়সা দেশের ভেতরে থেকে যায়, তার একটি বড় অংশ খরচ হয় ফ্ল্যাট বা জমি কেনার পেছনে।
‘অনেক সময় এসব সম্পত্তি কেনা হয় স্ত্রী, সন্তান বা স্বজনদের নামে। দেখা যায়, তাদের নামে হয়তো কোনো ট্যাক্স রিটার্ন দেয়া হয় না, ফলে এসব সম্পত্তির হিসাব সরকারের কাছেও আসে না। আবার অনেক সময় এগুলো পারিবারিক উপহার হিসাবেও দাবি করা হয়।’
সরকারিভাবেও বাজেট ঘোষণার সময় ‘কালো টাকা’ বলে পরিচিত এসব অবৈধ অর্থ আবাসন খাত বা শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ করার সুবিধা দেয়া হয়েছে, যেখানে সরকারিভাবেই নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে, অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হবে না।
ফলে দেশের ভেতরে থাকা দুর্নীতির বেশির ভাগ অর্থ জমি এবং ফ্ল্যাট ক্রয়ে ব্যয় হয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আগে একসময় ‘কালো টাকা’ দিয়ে সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে এফডিআর করে রাখা হতো। তবে এখন সঞ্চয়পত্রে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা আর ব্যাংকে নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় এসব খাতে ‘কালো টাকার’ বিনিয়োগ প্রবণতা কিছুটা কমেছে।
দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে অনেকে স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান সামগ্রী ক্রয়, ব্যবসায় বিনিয়োগ ইত্যাদি খাতেও খরচ হয়েছে।
আর দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত বড় অংকের অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায় বলে বলছেন অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ।
এই অর্থ দেশের অর্থনীতিতে
কতটা ভূমিকা রাখে?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এবং বিআইডিএসের গবেষক নাজনীন আহমেদ জানান, অনেকে দাবি করলেও আসলে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ অর্থনীতিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। বরং এক্ষেত্রে যদি দুর্নীতি না হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা অনেক বেশি উপকারী হতো।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি যেভাবে বাড়ছে, সেখানে যদি দুর্নীতি না হতো, তাহলে কমপক্ষে তিন থেকে চার শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেত।
‘এতে কোনো কোনো ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ হচ্ছে, কিন্তু যেহেতু এগুলো ঘোষণা করা হয় না, ফলে এর বিপরীতে রাষ্ট্র কোনো কর পায় না। ফলে এসব সম্পদ রাষ্ট্র বা জনগণের কোনো কাজে লাগে না। দুর্নীতির টাকায় ওই ব্যক্তি বা পরিবারের নিজের লাভ হলেও এটি দেশের অর্থনীতিতে আসলে কোনো অবদান রাখে না।’
নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘অনেকে দুর্নীতির টাকায় মসজিদ করেন বা স্কুল-মাদ্রাসায় দান করেন। কিন্তু তিনি যে দুর্নীতি করে এই অর্থ উপার্জন করেছেন, সেটা করা না হলে অনেক বেশি মানুষ উপকৃত হতে পারত।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির টাকার একটা অংশ ঘুরেফিরে অর্থনীতি আসতে পারে। কিন্তু দুর্নীতির অর্থ অর্থনীতিতে এসে যতটা উপকার হচ্ছে, সেটা না হয়ে বৈধ পথে হলে অনেক বেশি উপকার হতো। তাহলে সেই টাকা সামাজিক কল্যাণে ব্যয় হতে পারত, সমবণ্টন হতো। কিন্তু দুর্নীতির কারণে উপার্জিত অর্থ থেকে ওই ব্যক্তি লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজের কোনো উপকার হচ্ছে না।’
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থের বড় একটি অংশ দেশের বাইরেও পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে জানান মি. ইফতেখারুজ্জামান।
অর্থপাচার
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আমদানি, রপ্তানি, হুন্ডি এবং সেকেন্ড হোমের নামে গোপনে অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে।
এ নিয়ে গত বছর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান কবির।
সেখানে তিনি উলেস্নখ করেছেন, দেশ থেকে মূলত চারটি কৌশলে বিদেশে অর্থপাচার করা হচ্ছে। এগুলো হলো আমদানি-রপ্তানিতে পণ্য ও সেবার ওপর অতিরিক্ত বা কম ইনভয়েসিং বা মূল্য দেখানো। শিপমেন্টের ওপর আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং করা। আমদানি-রপ্তানিতে বহু ধরনের ইনভয়েসিং করা এবং পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া।
অর্থাৎ রপ্তানি করে একশো টাকা পেলে সেখানে দেখানো হচ্ছে আশি টাকা। আবার আশি টাকার আমদানি করা হলে দেখানো হচ্ছে একশো টাকা। এই অতিরিক্ত অর্থ বিদেশেই থেকে যাচ্ছে।
অনেক সময় সরকারি প্রণোদনা পেতে রপ্তানি মূল্যে বেশি মূল্য দেখানো হয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য থাকে। যেসব পণ্য আমদানিকে কম শুল্ক দিতে হয়, সেগুলোর মূল্য বেশি দেখানো হয়।
‘ব্যাংক কর্মকর্তাদের পক্ষে তো প্রতিটি পণ্যের দাম যাচাই বাছাই করা সম্ভব নয়। আর সেটা করার জন্যও তারা বেশি আগ্রহী হন না, কারণ তাহলে তাদের গ্রাহক হারাতে হতে পারে। ফলে এটা খুব একটা ঠেকানো যাচ্ছে না।’ বিবিসিকে বলছিলেন শাহ মো. আহসান হাবিব।
বিদেশে অর্থ পাচারের আরেকটি বড় উৎস ‘সেকেন্ড হোম।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এক্ষেত্রে তো ঘোষণা দিয়ে টাকা নিয়ে যাওয়া হয় না। গোপনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা বেশির ভাগ সময় ধরাই সম্ভব হয় না। না হলে দেখুন, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামের বড় একটি অংশ বাংলাদেশিরা নিয়েছেন।’
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতেও এভাবে অর্থ সরিয়ে নিয়ে অনেকেই দ্বিতীয় একটি ঠিকানা তৈরি করছেন। বিদেশে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বা চিকিৎসার নামেও অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে বলে জানান গবেষকরা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সুইস ব্যাংকে বিভিন্ন দেশের মানুষের গত এক দশক ধরে যে অর্থলগ্নি হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কিন্তু এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, যেহেতু বিদেশি ব্যাংকে যাওয়া বাংলাদেশিদের এসব অর্থের তথ্য সহজে পাওয়া যায় না, তাই এক্ষেত্রে নজরদারিও পুরোপুরি করা সম্ভব হয় না। সঠিক তথ্যের অভাবে মামলা করা যায় না। আবার মামলার প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ না থাকলে বিদেশি সরকারগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে পাঠানো অর্থের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে চায় না।
ফলে বিদেশে অর্থপাচারের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসলে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না বলে কর্মকর্তারা বলছেন।
দুর্নীতির টাকা সনাক্ত
\হকরা যায় কী?
উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতির অর্থ বা কালো টাকা দমনে ‘ফলো দ্য মানি’ বলে একটি রীতি চালু রয়েছে। এর মাধ্যমে টাকার উৎস শনাক্ত করার মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিতে শনাক্ত করা হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের আইনে শতভাগ না হলেও অনেক বিধান রয়েছে। কিন্তু এখানে অনিয়মের বা দুর্নীতির এমন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে যে, যারা এসব অর্থ খুঁজে বের করবেন, তারাই নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। ফলে আইন থাকলেও সেটার বাস্তবায়ন ঠিকভাবে হয় না, ফলে দুর্নীতিও বন্ধ হয় না।’
‘আমাদের দেশে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ব্যবহার করা তো কঠিন নয়। এখানে ট্যাক্স দেয়া না হলে তাকে তো ধরাই হয় না। অর্থের উৎস কী, সেটাও জোরালোভাবে জানতে চাওয়া হয় না।’
‘ফলে দুর্নীতির টাকার ব্যবহার বন্ধের যে পরিবেশ থাকা উচিত, সেই পরিবেশটাই এখানে তৈরি হয়নি।’ বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। বিবিসি বাংলা