ঢাকা ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৪:২৪:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১
  • / 34

প্রতীকী ছবি

মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র পাচারের পর মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানবপাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল কার্যক্রম হচ্ছে মানবপাচার।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও এই অপকর্মের জন্য ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ২০২১ সালে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে র‌্যাব। পাচারের শিকার অনেককে উদ্ধারও করতে পেরেছে সংস্থাটি। মানবপাচারের শিকার হতে যাওয়া ১৩৯ জনকে উদ্ধার ও এর সঙ্গে জড়িত ৩৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ১২৬ জন ও পুরুষ ২৭ জন।

প্রতি বছর হাজারো মানুষ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছে। পাচারকারীরা ব্যবহার করছে অভিনব সব কৌশল। সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ভালো চাকরির প্রস্তাব, মডেলিং, বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ, কিশোরী ও তরুণীদের টিকটক তারকা হবার স্বপ্ন প্রভৃতি।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, গত ১০ বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে ৫০ হাজার বাংলাদেশি নারী পাচার হয়েছেন। তবে এখন আর পাচার শুধুমাত্র দালালদের মাধ্যমেই হচ্ছে না; পাচারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বিশ্বাসযোগ্য উপায় ব্যবহার করছে পাচারকারীরা।

আর গত বছর র‌্যাবের মানব পাচারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫৬টি অভিযান চালিয়ে ৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পাচার হতে যাওয়া ৬৬ জন ভিকটিম উদ্বার করেছে। এর মধ্যে নারী ৩৬ জন ও পুরুষ ৩০ জন। এসব ঘটনার বিপরীতে মামলা হয়েছে ৫২ টি।

পাচারের কৌশল হিসেবে করা হয় বিয়েঃ

সম্প্রতি ২০০ জন নারীকে ভারতে পাচারের অভিযোগে গুজরাটের সুরাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বাংলাদেশের যশোরের মনিরুল ইসলাম মনিরকে। এই পাচারকারী নারীদের পাচার করার সহজ কৌশল হিসেবে বিয়েকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

আটকের পর মনির স্বীকার করেছে, বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ে করে তাদের পাচার করাই তার পেশা। পাচারের উদ্দেশ্যে মনির বিয়ে করেছে ৭৫টি। বিয়ের পর স্ত্রীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে নিয়ে যেতো কলকাতায়। তারপর তাদের বিক্রি করে দিতো ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে। ভারতীয় পুলিশ গত ১১ মাসে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১ বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করে। তাদের কাছে মুনিরের নাম জানতে পেরে তার খোঁজে ১০ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে। শেষ পর্যন্ত মনিরকে আটক করা হয়।

এ বছরের সেপ্টেম্বরে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা লিটন ও আজাদ। বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বহু বিবাহ করেছে লিটন। ৫ বছর থেকেছে ইতালিতে।। প্রথমে সে ইরাকে মেডিকেলে চাকরির প্রলোভন দেখাতো। পরে সখ্য গড়ে দিতো বিয়ের প্রস্তাব। এরপর কাউকে টেলিফোনে কিংবা সরাসরি দেশে এসে বিয়ে সম্পন্ন করত। নারীদের বিদেশ পাচারের জন্যই বিয়ে করত লিটন। বিশেষ করে বিউটি পার্লারে কাজ জানা নারী ও নার্সিং পেশায় নিয়োজিত নারীদের পাচার করেছে সে। সেখানে সুপারশপে চাকরির প্রলোভনে তারা নারীদের পাচার করত। ইরাক, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে জিম্মি করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করত। এসব দেশে তাদের একাধিক সেফহাউজ রয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২’শত নারী-পুরুষকে তারা পাচার করেছে।

এরপর অক্টোবরে রাজধানীর বনানী থানা এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা সুজন সিকদার ও সহযোগী রমজান মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব বলেছে, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা প্রথমে দরিদ্র পরিবারের নারীদের টার্গেট করতো। এরপর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য মৌখিকভাবে বিয়ে করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি মোবাইলে ধারণ করতো। এরপর ফাঁদে ফেলে করা হতো বিদেশে পাচার।

এ বিষয়ে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, মানবপাচারকারীরা দরিদ্র ও সুন্দরী নারীদের টার্গেট করতো। এরপর নারীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য মৌখিকভাবে তাদের বিয়ে করতো। বিয়ের পর ভিকটিমদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে তা ধারণ করে রাখতো মোবাইলে। পরে পার্শ্ববর্তী দেশে লোভনীয় চাকরি দেয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পাচার করে দিতো।

শুধু যে বাঙালি নারীরাই এই পাচারের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। আদিবাসী নারীরাও বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছেন। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, গত ৫ বছরে প্রায় ৪৫০ জন আদিবাসী নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। এই পাচারের সঙ্গে ১০টি ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পৃক্ততাও খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

জানা গেছে, এই ধরনের ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক যোগাযোগের পর চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে বিয়ের পর চীনে নিয়ে যায়। কয়েক মাস পরই তাদেরকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেখানকার বিভিন্ন যৌন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসি মেয়েরাই এই ধরনের পাচারের শিকার হচ্ছেন বেশি।

টিকটকের আকর্ষণীয় ফাঁদঃ

এ বছরের জুন মাসেই নারী পাচারের আরেকটি অভিনব কৌশলের কথা জানা যায় ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি নারী নির্যাতনের ভিডিও দেখে। সেই ভিডিওর সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে বিশাল ঘটনা। জানা যায়, টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়েছে অনেক নারীকে। পাচারের শিকার এক তরুণী ভারত থেকে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে।

২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ভিডিও ভাইরাল হওয়া তরুণীর। কখনো টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে, আবার কখনো ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট করে হৃদয়। পরে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করা হয়।

এছাড়াও এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এই তরুণীকে চক্রের অন্যান্যদের সহায়তায় সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেয় হৃদয়।

ওই তরুণীর দেয়া তথ্যমতে পুলিশ জানায়, ভারতে পাচারের পর তাকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় ভারতে এ চক্রের দ্বারা পাচারকৃত আরো কয়েকজন বাংলাদেশি ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান। যাদেরকে সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

চাকরির প্রলোভনঃ

বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছেন। তবে পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে যৌন পল্লী। তারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুই বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর সেদেশের সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ থেকে কত নারী প্রতিবছর পাচার হয় সে বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।

এছাড়াও মানবপাচারের কিছু মূল হোতাকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানা গেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অথবা তারা নিজেরাই ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ।

এবিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, মানবপাচার রোধে র‌্যাব সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। এর জন্য র‌্যাবের বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী নিয়মিত কাজ করছে।

মানব পাচার কেন বন্ধ হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে অজ্ঞতার অভাব রয়েছে। এছাড়াও যারা বিদেশ যেতে চান, তারা বিভিন্ন সময় প্রতারণার শিকার হয়েও সামাজিক কারণে এমনকি পাচারকারীদের ভয়ে তথ্য দিতে চান না। এরপরও আমাদের বাহিনী নিজ উদ্যেগে অনেক ভিক্টিমকেও উদ্বার করেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি জানায় যে, গত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে আসা নারীদের খুব কমই তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জানান। অনেকের হয়ত বলার মতো মানসিক অবস্থাও থাকে না। এর পেছনে কাজ করে সমাজ, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে হেয় হবার ভয়। কারণ, অনেক নারী ফিরে এসে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে আবারও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। অনেকেই ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়। পারিবারিকভাবে সমর্থন না পাওয়ায় অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়ছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবপাচার বন্ধের জন্য খুব বেশি যে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র উদ্যোগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। কিন্তু এটি শুধুমাত্র আইন দিয়েই বন্ধ হবার নয়। কারণ পাচারকারীরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে পাচার অব্যাহত রাখছে। পাচার প্রতিরোধে আইনের পাশাপাশি সেই প্রতিরোধের উপায়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। তাতে হয়তো আশানুরূপ ফল আসতে পারে।

নিউজ লাইট ৭১

Tag :

শেয়ার করুন

মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম

আপডেট টাইম : ০৪:২৪:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১

মাদক ব্যবসা ও অস্ত্র পাচারের পর মানবপাচার হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম। মানবপাচারের সঙ্গে প্রথম দুটি অপরাধও প্রায়ই জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রগুলোর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল কার্যক্রম হচ্ছে মানবপাচার।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও এই অপকর্মের জন্য ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ২০২১ সালে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে র‌্যাব। পাচারের শিকার অনেককে উদ্ধারও করতে পেরেছে সংস্থাটি। মানবপাচারের শিকার হতে যাওয়া ১৩৯ জনকে উদ্ধার ও এর সঙ্গে জড়িত ৩৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ১২৬ জন ও পুরুষ ২৭ জন।

প্রতি বছর হাজারো মানুষ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছে। পাচারকারীরা ব্যবহার করছে অভিনব সব কৌশল। সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ভালো চাকরির প্রস্তাব, মডেলিং, বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ, কিশোরী ও তরুণীদের টিকটক তারকা হবার স্বপ্ন প্রভৃতি।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, গত ১০ বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে ৫০ হাজার বাংলাদেশি নারী পাচার হয়েছেন। তবে এখন আর পাচার শুধুমাত্র দালালদের মাধ্যমেই হচ্ছে না; পাচারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বিশ্বাসযোগ্য উপায় ব্যবহার করছে পাচারকারীরা।

আর গত বছর র‌্যাবের মানব পাচারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৫৬টি অভিযান চালিয়ে ৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পাচার হতে যাওয়া ৬৬ জন ভিকটিম উদ্বার করেছে। এর মধ্যে নারী ৩৬ জন ও পুরুষ ৩০ জন। এসব ঘটনার বিপরীতে মামলা হয়েছে ৫২ টি।

পাচারের কৌশল হিসেবে করা হয় বিয়েঃ

সম্প্রতি ২০০ জন নারীকে ভারতে পাচারের অভিযোগে গুজরাটের সুরাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বাংলাদেশের যশোরের মনিরুল ইসলাম মনিরকে। এই পাচারকারী নারীদের পাচার করার সহজ কৌশল হিসেবে বিয়েকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

আটকের পর মনির স্বীকার করেছে, বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ে করে তাদের পাচার করাই তার পেশা। পাচারের উদ্দেশ্যে মনির বিয়ে করেছে ৭৫টি। বিয়ের পর স্ত্রীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে নিয়ে যেতো কলকাতায়। তারপর তাদের বিক্রি করে দিতো ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে। ভারতীয় পুলিশ গত ১১ মাসে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১ বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করে। তাদের কাছে মুনিরের নাম জানতে পেরে তার খোঁজে ১০ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে। শেষ পর্যন্ত মনিরকে আটক করা হয়।

এ বছরের সেপ্টেম্বরে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা লিটন ও আজাদ। বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বহু বিবাহ করেছে লিটন। ৫ বছর থেকেছে ইতালিতে।। প্রথমে সে ইরাকে মেডিকেলে চাকরির প্রলোভন দেখাতো। পরে সখ্য গড়ে দিতো বিয়ের প্রস্তাব। এরপর কাউকে টেলিফোনে কিংবা সরাসরি দেশে এসে বিয়ে সম্পন্ন করত। নারীদের বিদেশ পাচারের জন্যই বিয়ে করত লিটন। বিশেষ করে বিউটি পার্লারে কাজ জানা নারী ও নার্সিং পেশায় নিয়োজিত নারীদের পাচার করেছে সে। সেখানে সুপারশপে চাকরির প্রলোভনে তারা নারীদের পাচার করত। ইরাক, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে জিম্মি করে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করত। এসব দেশে তাদের একাধিক সেফহাউজ রয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২’শত নারী-পুরুষকে তারা পাচার করেছে।

এরপর অক্টোবরে রাজধানীর বনানী থানা এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা সুজন সিকদার ও সহযোগী রমজান মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব বলেছে, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা প্রথমে দরিদ্র পরিবারের নারীদের টার্গেট করতো। এরপর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য মৌখিকভাবে বিয়ে করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি মোবাইলে ধারণ করতো। এরপর ফাঁদে ফেলে করা হতো বিদেশে পাচার।

এ বিষয়ে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, মানবপাচারকারীরা দরিদ্র ও সুন্দরী নারীদের টার্গেট করতো। এরপর নারীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য মৌখিকভাবে তাদের বিয়ে করতো। বিয়ের পর ভিকটিমদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে তা ধারণ করে রাখতো মোবাইলে। পরে পার্শ্ববর্তী দেশে লোভনীয় চাকরি দেয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পাচার করে দিতো।

শুধু যে বাঙালি নারীরাই এই পাচারের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। আদিবাসী নারীরাও বিভিন্নভাবে পাচার হচ্ছেন। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, গত ৫ বছরে প্রায় ৪৫০ জন আদিবাসী নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। এই পাচারের সঙ্গে ১০টি ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পৃক্ততাও খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

জানা গেছে, এই ধরনের ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক যোগাযোগের পর চীনা নাগরিকরা বাংলাদেশে এসে বিয়ের পর চীনে নিয়ে যায়। কয়েক মাস পরই তাদেরকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেখানকার বিভিন্ন যৌন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসি মেয়েরাই এই ধরনের পাচারের শিকার হচ্ছেন বেশি।

টিকটকের আকর্ষণীয় ফাঁদঃ

এ বছরের জুন মাসেই নারী পাচারের আরেকটি অভিনব কৌশলের কথা জানা যায় ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি নারী নির্যাতনের ভিডিও দেখে। সেই ভিডিওর সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে বিশাল ঘটনা। জানা যায়, টিকটকের তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়েছে অনেক নারীকে। পাচারের শিকার এক তরুণী ভারত থেকে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের কাছে।

২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ভিডিও ভাইরাল হওয়া তরুণীর। কখনো টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে, আবার কখনো ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট করে হৃদয়। পরে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করা হয়।

এছাড়াও এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এই তরুণীকে চক্রের অন্যান্যদের সহায়তায় সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেয় হৃদয়।

ওই তরুণীর দেয়া তথ্যমতে পুলিশ জানায়, ভারতে পাচারের পর তাকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় ভারতে এ চক্রের দ্বারা পাচারকৃত আরো কয়েকজন বাংলাদেশি ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান। যাদেরকে সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

চাকরির প্রলোভনঃ

বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছেন। তবে পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে যৌন পল্লী। তারা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুই বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর সেদেশের সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ থেকে কত নারী প্রতিবছর পাচার হয় সে বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।

এছাড়াও মানবপাচারের কিছু মূল হোতাকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জানা গেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অথবা তারা নিজেরাই ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ।

এবিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, মানবপাচার রোধে র‌্যাব সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। এর জন্য র‌্যাবের বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী নিয়মিত কাজ করছে।

মানব পাচার কেন বন্ধ হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে অজ্ঞতার অভাব রয়েছে। এছাড়াও যারা বিদেশ যেতে চান, তারা বিভিন্ন সময় প্রতারণার শিকার হয়েও সামাজিক কারণে এমনকি পাচারকারীদের ভয়ে তথ্য দিতে চান না। এরপরও আমাদের বাহিনী নিজ উদ্যেগে অনেক ভিক্টিমকেও উদ্বার করেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি জানায় যে, গত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে আসা নারীদের খুব কমই তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জানান। অনেকের হয়ত বলার মতো মানসিক অবস্থাও থাকে না। এর পেছনে কাজ করে সমাজ, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে হেয় হবার ভয়। কারণ, অনেক নারী ফিরে এসে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে আবারও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। অনেকেই ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়। পারিবারিকভাবে সমর্থন না পাওয়ায় অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়ছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবপাচার বন্ধের জন্য খুব বেশি যে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র উদ্যোগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। কিন্তু এটি শুধুমাত্র আইন দিয়েই বন্ধ হবার নয়। কারণ পাচারকারীরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে পাচার অব্যাহত রাখছে। পাচার প্রতিরোধে আইনের পাশাপাশি সেই প্রতিরোধের উপায়গুলো চিহ্নিত করতে হবে। তাতে হয়তো আশানুরূপ ফল আসতে পারে।

নিউজ লাইট ৭১