ধর্ষণকারী কোন ধর্মের
- আপডেট টাইম : ১২:১৯:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯
- / 98
নিউজ লাইট ৭১ ডেস্ক: ভারতের হায়দ্রাবাদে একজন তরুণী পশু চিকিৎসক নৃশংস গণধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার পর ধর্ষণকারীদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে ওই শহরেরই একজন বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে।
‘ধর্ষণকারীরা নিশ্চয় মুসলিমই হবেন’, রাজা সিং নামে ওই বিজেপি এমএলএ সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন ইঙ্গিত করার পর হায়দ্রাবাদের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন তার তীব্র নিন্দা করেছে।
এরপর হায়দ্রাবাদের পুলিশ পর্যন্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের লোকজনই আছে।
এদিকে ভারতের বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সাইট বা টুইটার অ্যাকাউন্টে খোলাখুলিই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, ধর্ষণের অভিযোগ যখন মুসলিমদের দিকে তখন দেশের সেলেব্রিটিরা কেন নীরব?
গত বুধবার রাতে হায়দ্রাবাদ শহরের একটি টোল প্লাজার কাছে কয়েকজন ট্রাকচালক ও খালাসি মিলে একজন তরুণী পশুচিকিৎসককে গণধর্ষণ করে এবং পরে গলা টিপে তাকে হত্যা করে তার দেহটিও জ্বালিয়ে দেয়। এই নৃশংস ও ভয়াবহ অপরাধের বিরুদ্ধে তেলেঙ্গানা-সহ সারা দেশেই তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
কিন্তু হায়দ্রাবাদের শাদনগর থানার সামনে মানুষ যখন দোষীদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তখন শহরেরই বিজেপি বিধায়ক রাজা সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি এই ঘটনা থেকে সাম্প্রদায়িক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন।
ওই ঘটনায় প্রথম অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা সিং সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেন, “আমার আশা ছিল, এত ঘৃণ্য কাজ ঠিক মোহাম্মদ বা ওই রকম নামের কেউই করে থাকবে।”
“একজন গ্রেপ্তার হয়েছে, এখন দেখা যাক বাকি তিনজনকে কখন পুলিশ আটক করে!” যথারীতি এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন হায়দ্রাবাদের মুসলিমরা।
আহমদউল্লা হুসেইনি নামে মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয় একজন রাজা সিংকে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, “হায়দ্রাবাদের দুর্ভাগ্য যে তারা আপনার মতো লোককে ভোটে জিতিয়েছে।”
“হয় আপনি মুসলিমদের নিশানা করতে চাইছেন, অথবা এই ঘটনা ঘটবে সেটা আপনার আগে থেকে জানা ছিল।”
এদিকে এই ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা সাম্প্রদায়িক মোড় নিতে পারে, এই আশঙ্কায় পুলিশও তড়িঘড়ি বিবৃতি দিয়ে জানায় – অভিযুক্ত চারজনের নাম হল জল্লু শিভা, জল্লু নভিন, মোহাম্মদ আরিফ ও চিন্তাকন্ঠা চেন্নাকেশাভালু।
হায়দ্রাবাদ পুলিশের ডিজিপি প্রকাশ রেড্ডি সেই সঙ্গেই বলেন, “এই অপরাধের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই – কারণ অভিযুক্তদের মধ্যে উভয় ধর্মের লোকজনই আছেন।”
“যারা একে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের বিরুদ্ধেও আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব”, জানান তিনি।
সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদারও বিবিসিকে বলছিলেন, এই ঘৃণিত অপরাধীরা আসলে হিন্দু বা মুসলিম কিছুই হতে পারেন না।
তার কথায়, “যারা এই চূড়ান্ত অনৈতিক অপরাধ করতে পারেন, তারা তো আসলে কোনও ধর্মেরই নন – কারণ তাদের মধ্যে থেকে মানবিকতা জিনিসটাই অন্তর্হিত হয়েছে।”
“এদেরকে কেউ যদি ‘জান্তব’ বলেন সেখানেও আমি আপত্তি করব, কারণ যাদের আমরা পশু বা মানবেতর প্রাণী বলে থাকি তাদের জীবনযাপনেও কিন্তু একটা নীতি, একটা ধরন বা নির্দিষ্ট ঋতুকাল কাজ করে।”
“মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা প্রতি মুহুর্তে সেই নৈতিকতা লঙ্ঘন করে।”
“আর সেই লঙ্ঘন প্রতি বছর কোথাও না-কোথাও ঘটেই চলেছে – কখনও কাঠুয়া বা দিল্লিতে হয়েছে, আজ হায়দ্রাবাদে হল, এর আগে কামদুনি বা কোচবিহারেও হয়েছে!”
তিনি আরও মনে করছেন, ভারতের বাস্তবতাই হল এই সব ঘটনাকেই ধর্ম বা রাজনীতির প্রিজম দিয়ে দেখার চেষ্টা করা।
তিলোত্তমা মজুমদারের কথায়, “আরও বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় এই ধরনের ঘটনাতে অনেকে প্রতিবাদ করলেও আবার অনেকেই কিন্তু প্রতিবাদ করতেও এগিয়ে আসেন না।”
“বরং এই ঘটনাগুলোকে যে ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তারা সেই মেরুকরণের দিকেই সায় দিয়ে বসেন।”
“যেমন আমি বহু লোককেই বলতে শুনেছি, অমুক সম্প্রদায়ের লোকজনই তো বেশি অপরাধ করে, কাগজ খুললেই তো দেখি অপরাধী হিসেবে ওদের নামই বেশি!”
আর এই পটভূমিতেই পোস্টকার্ড নিউজের মতো বিজেপি-পন্থী প্ল্যাটফর্ম প্রশ্ন তুলেছে, কাঠুয়া এবং হায়দ্রাবাদের ঘটনায় ভারতের লিব্যারাল ও সেকুলার (উদারপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ) বলে পরিচিত তারকাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কেন ফারাক দেখা যাচ্ছে?
তারা বলছে, “কাঠুয়ার ঘটনায় যেখানে মূল ধর্ষণকারী ছিলেন হিন্দু মন্দিরের পুরোহিত – সেখানে জাভেদ আখতার, রাজদীপ সারদেশাই, বরখা দত্ত-রা অজস্র টুইট করলেও হায়দ্রাবাদের ঘটনা নিয়ে তারা কিছু বলছেন না কেন?”
অবশ্য হায়দ্রাবাদেও বাকি তিন হিন্দু অভিযুক্ত আটক হওয়ার পর পোস্টকার্ড নিউজ সেই টুইট মুছে ফেলেছে, বিধায়ক রাজা সিংও আর মুখ খোলেননি।