রাজধানীসহ সারাদেশে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে
- আপডেট টাইম : ০৬:১২:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১
- / 87
রাজধানীসহ সারাদেশে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে। সড়কে বা রিকশায়, বাসে কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচলের সময়, সকালে-দুপুর এমনকি সন্ধ্যায় জনাকীর্ণ কিংবা ফাঁকা রাস্তায় মানুষ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ছিনতাইয়ের মামলা ছিলো ৭৮টি। ২০১৯ সালে ১১৯ ও ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৬টিতে।
রাজধানীতে গত ৩ বছরে ছিনতাই বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে ঘটনার চেয়ে থানায় অভিযোগ পড়ছে কম। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পথচারী।
পুলিশ ও ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছিনতাইয়ে জড়িতদের বেশিরভাগই কিশোর, ভাসমান টোকাই, উঠতি তরুণ, মাদকাসক্ত, হোটেলে কাজ করা মেসিয়ার ও গাড়ি চালানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে রিকশাচালকের এগিয়ে বলেও জানান ভিকটিমরা।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে এখন প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ৪ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রূপায়ন খান প্লাজা ধানমন্ডি ৭নং সড়কের সামনে যানজটের মধ্যেই একজনের মোবাইল ছিনতাই করে দৌড়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারী। পরে একটি বাসে উঠে লুকানোর চেষ্টাকালে ছিনতাইকারী থেকে মোবাইল উদ্ধার করা হলেও তাকে ধরা যায়নি।
এছাড়া শহরে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ‘টানা পার্টি’র অত্যাচার বেড়েছে। ফার্মগেটে হরহামেশা ঘটছে প্রতিদিন। বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী বা বাসের ভেতরে ফোনে কথা বলা মানুষদের টার্গেট করে এসব গ্রুপ। একই চিত্র কারওয়ানবাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়ে।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী রুবেল হাসান বলেন, প্রতিদিনের মতো অফিস শেষ করে সেগুনবাগিচা থেকে বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। জানালার পাশে ফোনে কথা বলার সময় মুহূর্তের মধ্যেই হাত থেকে কারওয়ানবাজার সার্ক ফোয়ারা মোড় থেকে ফোন নিয়ে চলে যায়।
কারওয়ানবাজারসহ গুলিস্তান মোড়, মতিঝিল, মিরপুর ১ ও ১০ নং ওভারব্রিজ মিলিয়ে বেশকটি ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয়।
এ বিষয়ে পুলিশ জানিয়েছে, কিছু ভুক্তভোগী মামলা করেন, অনেকে করেন না। কোনও থানা যদি ছিনতাইয়ের মামলা না নিতে চায়, তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এদিকে বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে কারা কারা ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, গাড়ি ও মোটরসাইকেল চুরি প্রতিরোধে উড়াল সড়কে ওঠা ও নামার জায়গায় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) ও সাসপেক্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (এসআইভিএস) মতো সফটওয়্যার হালনাগাদ করে চোর-ছিনতাইকারীদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেছেন তিনি।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, গাড়ি ও মোটরসাইকেল ট্র্যাকিং সিস্টেমের আওতায় আসলে চুরি অনেকাংশে কমে যাবে।
বিপদের কথা হলো, ছিনতাইকারীরা এখন শুধু লোকজনের টাকাপয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়েই ভাগছে না। ছুরিকাঘাত করছে এমনকি গুলি করতেও দ্বিধা করছে না।
গত বছরের ২৮ নভেম্বর ঢাকার ধামরাইয়ের ইসলামপুরে মামার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসে জিসান। রাতে সে তার এক আত্মীয়কে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে আসে। বিমানবন্দর থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে জিসান তার অন্য এক আত্মীয়ের সঙ্গে বাসে ধামরাই ফিরছিলো। বাসটি উত্তরার আবদুল্লাপুরে পৌঁছালে এক ছিনতাইকারী জানালা দিয়ে ছো মেরে জিসানের মুঠোফোন নিয়ে নেয়। এ সময় জিসান ও তার সঙ্গে থাকা আত্মীয় বাস থেকে নেমে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করে জাপটে ধরে ফেলে। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী জিসানকে ছুরিকাঘাত করে মুঠোফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
এছাড়াও ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকার উত্তরায় অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীরা একটা চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে তার যাত্রী মা ও মেয়েকে গুলি করে ৬ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরদিন সোমবার সাভারে ছিনতাইকারীরা একটা চলন্ত বাস থামিয়ে ৩ যাত্রীকে গুলি করে মোট ছয় লাখ টাকা ছিনতাই করে।
গত ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর কদম ফোয়ারায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন হামিদুল ইসলাম (৫৫) নামে এক কেবল টিভির সংযোগ ব্যবসায়ী। তোপখানা রোডে তার বাসা। এই ঘটনায় তার বড় ছেলে নাহিদুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি মামলা করলে তাদের গ্রেপ্তার করে। তারা রিকশাচালক ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ জানায়।
গত মাসের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) এক শিক্ষার্থী ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে তালাইমারী মোড়ে চা পান করে রুমে ফিরছিলেন। তার গলায় ছুরি ধরে দুই ছিনতাইকারী মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় নগরের কাজলার অক্ট্রয়মোড়ে এ ঘটনা ঘটে।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সদরঘাটে ফিল্মী স্টাইলে টাকার ব্যাগ ছিনতাই করে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন সালাউদ্দীন আহমেদ তন্ময় নামে এক যুবক। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তন্ময় বারবার ফোনে কথা বলছেন। তাকে অনুসরণ করছে আরও কয়েকজন। সদরঘাট এলাকায় ৪৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পুলিশ দেড়শর বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, করোনার সময় কিছুটা চুরি, ছিনতাই বেড়েছিলো। তবে আমাদের তৎপরতায় এখন অনেকটাই কমে গেছে।
তিনি বলেন, থানায় মামলা হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করি। ছিনতাই যতো হয় মামলা সে হারে হয় না এমন প্রশ্নে হাফিজ আক্তার বলেন, ডিএমপি কমিশনার প্রতিটি থানায় নির্দেশ দিয়েছেন মামলা নিতে এবং ভুক্তভোগীদের সবভাবে সাহায্য করতে।
ডিবির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে চান না। আমরা তাদের আশ্বাস দিয়ে মামলা করাচ্ছি। থানায় মামলা নিতে হয়রানি করলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জানানোর সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা যদি নিজে থেকে এসে মামলা না করে সেক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে খুঁজে বের করে মামলা করানো সম্ভব হয় না। আমরা চাই সবাই মামলা করে আমাদের সহযোগিতা করুক।
ডিবি পুলিশ জানায়, ৯ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীতে পেশাদার ডাকাত দলের পাঁচজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ লালবাগ বিভাগ। গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ বিশেষ অভিযান চালিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। এ চক্রের সদস্যরা দিনের বেলায় রাজমিস্ত্রি, ডেকোরেশন ও হোটেলে কাজ করে। রাতের বেলায় একত্রিত হয়ে দল গঠন করে ডাকাতি করে।
গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মধুসূদন দাস নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, এরা দিনের বেলায় ফেরিওয়ালা সেজে বাড়ি রেকি করে। পরে গভীর রাতে বা সুবিধামতো সময়ে বাড়ি ও দোকানের তালা কেটে টাকা, গাড়ি, মোবাইলসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে দ্রুত গাড়িতে করে পালিয়ে যায়।
ছিনতাই হলেও মামলা কম হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় ছোট চুরিগুলোতে ভিকটিমরা মামলা করতে চায় না। তারা ভয় পায় এসব ছোট বিষয়ে মামলা করতে। তারা ভাবে, মামলা করেতে গেলে যেতে আসতে এর জন্য অনেক সময় এবং টাকা খরচ হয়ে যাবে।
নিউজ লাইট ৭১