দিল্লিকা লাড্ডুই বলা হয় হাওয়াই মিঠাইকে
- আপডেট টাইম : ০৬:৩৭:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১
- / 84
কাঠির মাথায় যেন এক টুকরো গোলাপি কিংবা সাদ রঙের মেঘ। ইংরেজিতে কটন ক্যান্ডি,ক্যান্ডি ফ্লস কিংবা স্পুন সুগার বললেও বাংলাই বুড়ির মাথার পাকা চুল কিংবা দিল্লিকা লাড্ডুই বলা হয় হাওয়াই মিঠাইকে। একসময় এই ‘হাওয়াই মিঠাই’ গ্রামাঞ্চলেই বেশি দেখতে পাওয়া যেতো। কিন্তু, আধুনিকতার ছোঁয়ায় একেবারে বিলীন না হলেও এর বিচরণ কমেছে। তবে এই হাওয়ায় মিঠাই ঐতিহ্যের স্বাক্ষী। আশি-নব্বই দশকের মানুষের শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই হাওয়ায় মিঠাইয়ের সাথে।
‘হাওয়াই মিঠাই নেবে… হাওয়াই মিঠাই….মিষ্টি নরম রং-বেরঙের হাওয়াই মিঠাই…!’ এক সময় ক্লান্ত দুপুরে এভাবেই হাক-ডাক দিয়ে গ্রামের রাস্তায় হাজির হতেন হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালারা। পিতল বা কাঁসার ঘণ্টার টিং টিং শব্দই জানান দিত ফেরিওয়ালার হাজিরার। তার সঙ্গে টিন-কাচের একটি বাক্স ভর্তি থাকতো ছোট ছোট হাওয়াই মিঠাই।
ফেরিওয়ালার এই ডাক শুনেই ছুঁটে আসতো ছেলেমেয়েরা। সেই সময় ২৫ পয়সা থেকে ১ টাকা খরচ করলেই মিলতো কয়েক পিছ হওয়ায় মিঠাই। তবে শুধু টাকা নয় পুরনো প্লাস্টিক, লোহার টুকরো কিংবা কাচের বোতলের বিনিময়েও মিলতো সুস্বাদু এই হওয়ায় মিঠাই।
এছাড়াও গ্রামীন মেলাতেও দেখা মিলত হাওয়াই মিঠাইয়ের। বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে দেখা পাওয়া যেত হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালাদের। সেই সময় ধানের বিনিময়ে মিলত হাওয়াই মিঠাই।
এই হাওয়াই মিঠাই নিয়ে রয়েছে মজার মজার স্লোক ও। যেমন, হাওয়াই মিঠাই যা খাইলেও পস্তাবেন, আর না খাইলেও পস্তাবেন।
তবে কালের বিবর্তনে বদলে গেছে হাওয়াই মিঠাইয়ের ধরণ। কাচে ঘেরা টিনের বাক্সের ছোট ছোট হাওয়াই মিঠাই এখন আকারে ফুলে ফেঁপে বেশ বড় হয়েছে। এখন কাঠিতে পেঁচিয়ে পলিথিনে মোড়ানো বিভিন্ন রঙের হাওয়াই মিঠাই দেখা যায় শহরের পথে পথে। এছাড়াও রঙে এবং দামেও এসেছে পরিবর্তন। এখন আর সেই ২৫ পয়সা কিংবা ১ টাকায় পাওয়া যায়না হাওয়াই মিঠাই। একটি হাওয়ায় মিঠাই খেতে হলে আপনাকে গুনতে হবে দশ থেকে পনেরো টাকা। এছাড়াও এখন শুধু গোলাপী আর সাদা নয় সবুজ, হলুদ কিংবা হালকা আকাশী রঙেরও মিলবে হাওয়াই মিঠাই।
তবে সুস্বাদু এই খাবারটির ইতিহাস কিন্তু জুড়ে আছে ইতালির সাথে। অর্থাৎ হাওয়াই মিঠাইয়ের আদি ঘর ইতালিতে। চৌদ্দশতকে ইতালিতে চিনি দিয়ে তৈরি এই মজার খাবারটি প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় ঘরোয়া ভাবেই সামান্য চিনির ঘন রস বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোর মতো তৈরি করে বানানো হত হাওয়াই মিঠাই। আঠারো শতক পর্যন্ত এইভাবে তৈরি হয়েছে। ১৮৯৭ সালে মার্কিন উইলিয়ম মরিসন ও জন সি. ওয়ারটন হাওয়াই মিঠাই তৈরির জন্য প্রথম মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিনের সাহায্যে চিনির যে সুতো তৈরি হতে লাগল সেগুলো আরও সূক্ষ্ম আর বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তাড়াতাড়ি খাবারটা তৈরি হয়ে যেতে লাগল। তবে মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই তখন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।
ব্যাপকভাবে এর প্রসার বাড়ে ১৯০৪ সালে। সে বছর মরিসন এবং ওয়ারটন তাদের মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাজির হলেন সেন্ট লুইসের বিশ্ব মেলায়। অবাক হওয়ার বিষয়, মেলার প্রথম দিনই ২৫ সেন্ট করে ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের হিসাবে অনেক বড় একটা অঙ্ক! ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় খাবারটি। চাহিদা ও জনপ্রিয়তার জন্য একাধিক কোম্পানি এগিয়ে এল এই মজাদার খাবারটি উৎপাদন ও বিপণনে। টটসি রোল অফ কানাডা লি. বিশ্বের সর্বাধিক হাওয়াই মিঠাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
দেখতে অনেকটা তুলার মতো বলে ১৯২০ সালে মার্কিনরা এই মিঠায়ের নাম দিয়েছে ‘কটন ক্যান্ডি’। তারা এই হাওয়াই মিঠায়ের এতই ভক্ত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ ডিসেম্বর দিনটি ‘জাতীয় কটন ক্যান্ডি ডে’ হিসাবে পালন করা হয়।
দামি চকলেট, আইসক্রিম কিংবা ক্যান্ডিতে সয়লাব বাজারেও হাওয়াই মিঠাইয়ের কদর বাড়তে থাকে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এ খাবার।
হাওয়ায় মিঠাই কেবল একটি খাবার নয়, এটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যেও বটে। এই হাওয়াই মিঠাইয়ের সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য শিশু-কিশোরবেলার স্মৃতি।
নিউজ লাইট ৭১