কাউন্সিলর তিতুর অবৈধ দখলে কোটি কোটি টাকার প্লট
- আপডেট টাইম : ১১:০৯:০১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০১৯
- / 173
মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে সনি সিনেমা হলের ঠিক উল্টোপাশের বিশাল বিপণি বিতান ‘স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেট’। এই বিপণি বিতানে একটি দোকান ভাড়া নিতে স্থানভেদে মাসিক ভাড়া গুনতে হয় ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতিটি দোকানের জন্য জামানত হিসেবে দিতে হয় ১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা। ৬৬ দশমিক ৬৬ কাঠা জমির ওপর গড়ে ওঠা এই মার্কেটে দোকান রয়েছে কমপক্ষে ৩শ। আইনের দৃষ্টিতে এসব দোকান মালিকের সবাই অবৈধ দখলদার। কারণ নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) থেকে প্লটের বরাদ্দ নেননি তারা। এসব অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে জমির মালিক জাগৃকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। তবুও দখলদাররা আছেন বহাল তবিয়তে। আবার অবৈধ প্লটে যে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে সেটিরও কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু এত কিছুর পরও সংশ্লিষ্ট সংস্থার নাকের ডগায় টিকে আছে এই মার্কেটটি। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন তিতুর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রভাবের কারণে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বেপরোয়া প্রকৃতির ইকবাল হোসেন তিতু কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগেই এলাকায় নানা অপকর্মে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন। আর ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরও পাকাপোক্ত হয়। মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতা, ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে দোকান বসিয়ে বাণিজ্য, অন্যের জমি দখল এবং এলাকার ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও তার কব্জায়। আর এসব কিছু করতে তিতুর রয়েছে নিজস্ব কর্মীবাহিনী। তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ নিউজ লাইট ৭১ কাছে অস্বীকার করেছেন কাউন্সিলর তিতু।
নিউজ লাইট ৭১ অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে মিরপুর ১ নম্বর সেকশনে জাগৃকের জমিতে কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন তিতু ও তার ভাই লিটুর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেট গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। বর্তমান বাজারদর প্রতি কাঠা পৌনে ৩ কোটি টাকা হিসাবে এই ৬৬ দশমিক ৬৬ কাঠা জমির মূর্য দাঁড়ায় ১৫০ কোটি টাকা। ইমারত নির্মাণের ড়্গেত্রে তারা কোনো ধরনের অনুমোদনও নেননি। নির্মাণকাজ শেষে প্রায় ৩০০টি দোকান ভাড়াও দেওয়া হয়েছে। এসব দখলদার দোকান মালিককে উচ্ছেদ করতে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার গঠনের পর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশও করেছিল। আবার জমির মালিক জাগৃকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরিও করা হয়। তারপরও দখলদাররা আছেন বহাল তবিয়তে।
জাগৃক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই জায়গাটি এলএ কেস নম্বর ১৩/৫৯-৬০ এর আওতায় জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণের পর জাগৃককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মোট ৬৬.৬৬ কাঠা জায়গায় ১৯৯০ সালে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ১৪টি প্লট তৈরি করা হয়। এ প্লটগুলোর মধ্যে ৮.৩২ কাঠা সুফিয়া খাতুন, ৮.৩৩ কাঠা আওলাদ হোসেন, ৮.৩৩ কাঠা সামসুদ্দিন আহমেদ, ৮.১৩ কাঠা মোছা. জরিনা খাতুন, ৭.৭৫ কাঠা হাজেরা খাতুন, ৪.১৬ কাঠা রেহেনা আক্তার, ৩.৫৪ কাঠা গোলাম হোসেন, ৩.৫৬ কাঠা হাজি নূর মোহাম্মদ, ২.০৪ কাঠা আশরাফ উদ্দিন, ২.৫০ কাঠা লাবিব উদ্দিন, ২.৫০ কাঠা আব্দুল হাই, ২.৫০ কাঠা ফজিলাতুন্নেছা, ২.৫০ কাঠা জামাল উদ্দিন চৌধুরী ও ২.৫০ কাঠার প্লট রুহুল আমিন খাঁনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কাগজপত্রে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তারা আজও দখল বুঝে পাননি।
এ ব্যাপারে জানতে জাগৃকের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. রাশিদুল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অভিযোগের শেষ নেই কাউন্সিলর তিতুর বিরুদ্ধে : স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ঘনবসতিপূর্ণ ১২ নম্বর ওয়ার্ড বর্তমানে মাদকে ছেয়ে গেছে। তিতু কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার ঘনিষ্ঠ লোকজন জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত সুজন, মাসুম, আসলাম, ভাগ্নে ভাস্কর, খোকন, মিরাজ (কৃষক লীগ) ও আহম্মেদনগরের শেখ মামুন ওরফে ডাইল মামুন এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। মিরপুরের আহম্মেদনগর, শাহ আলী বাগ, জোনাকী রোড, ধানক্ষেতের মোড়, পুকুরপাড়, সালেমুদ্দিন মার্কেট, মনির উদ্দিন মার্কেট ও জনতা হাউজিং এলাকায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় নানা মাদকদ্রব্য। তবে মনির উদ্দিন মার্কেট এলাকায় পুলিশ ও র্যাবের সোর্স পরিচয়দানকারী ডাইল মামুন এখন নিজেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালের শেষ দিকে পাইকপাড়া এলাকায় সুরুজ খানের বাড়ি সংলগ্ন নৌ-পুলিশের অফিসের পাশে একটি সাড়ে তিন কাঠা জমি দখলে নেন বাদল ও রফিক নামের দুই ব্যক্তি। কাউন্সিলর তিতু নেপথ্যে থেকে এই দুজনকে দিয়ে প্লটটি দখল করিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কাউন্সিলর তিতুর আপন ভাই কামাল জনতা হাউজিং এলাকায় ৬/৭টি প্লট দখল করেছেন বলেও স্থানীয় লোকজন নিউজ লাইট ৭১ কে জানিয়েছেন।
সরজমিন দেখা যায়, দারুসসালাম রোডের কিয়াংসি চাইনিজের সামনে দিয়ে আহম্মেদনগর এলাকায় ঢzকতেই রাস্তার দুই পাশে অস্থায়ী দোকান। মূল সড়ক থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও এখানে রাস্তায় কমপক্ষে একশ দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে কাউন্সিলর তিতুর ছোট ভাই লিটুর শ্যালক ছাত্রলীগ নেতা রিমু এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষকলীগ নেতা মিরাজ টাকা আদায় করেন। এছাড়া মিরপুর ১ নম্বর এলাকা হয়ে যেসব বাস-লেগুনা যাতায়াত করে সেগুলো থেকে শ্রমিক নেতা দেলোয়ারের মাধ্যমে অর্থ পান কাউন্সিলর তিতু। নিজ এলাকার ডিশ ও ইন্টারনেট বাণিজ্যটাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তিতুর।
জানা গেছে, মিরপুরের গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলে ছয় তলায় একটি কক্ষ বরাদ্দ রয়েছে কাউন্সিলর তিতু ও তার অনুসারীদের জন্য। সেখানে রাতে বসে আড্ডা। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ সামসুল হক ও অন্য অনুসারীদের সেখানে রাতভর জুয়া খেলার অভিযোগও পাওয়া গেছে। তবে সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী চলমান অভিযানের পর সেখানে আর তিতু বা তার অনুসারীদের যাতায়াত খুব একটা নেই।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হয় কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন তিতুর সঙ্গে। তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ‘স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেটটি আমার ভাই লিটু ও আব্দুল হাই মিলে একটি সমিতির মাধ্যমে পরিচালনা করছে। সেখানে আমি জড়িত না। আর আহম্মেদনগর এলাকায় আমি কোনো দোকান বসিয়ে টাকা নিই না।’
পাইকপাড়ায় সাড়ে তিন কাঠার প্লট দখলের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি বাদল এবং আরও কয়েকজন মিলে এক প্রবাসীর একটি প্লট দখল করেছে। সেখানে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এছাড়া মাদক ব্যবসা ও পরিবহন থেকে যারা চাঁদাবাজি করে তারা কেউ আমার ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত নয়। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাব যে আমার নাম দিয়ে যদি কেউ কোনো অপরাধ করে তাহলে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।