এক মাসে দেড় টন স্বর্ণবার এনেছেন প্রবাসীরা
- আপডেট টাইম : ০৭:২২:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২০
- / 102
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এক মাসে দেড় টন স্বর্ণবার এনেছেন প্রবাসীরা। এসব প্রবাসীর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক। এসব সোনার বার চোরাচালান হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
করোনাভাইরাসের শুরুতে বিমান চলাচল বন্ধ থাকার সময় বিমানবন্দর দিয়ে বৈধ বা অবৈধ কোনো সোনাই দেশে আসেনি। কিন্তু চোরাচালান থেমে নেই। কখনো প্যান্টের ভেতর, কম্বলের ভেতর, পেটের ভেতর, বিমানের টয়লেটে, যাত্রীর জুতোর ভেতর, মানিব্যাগে, লাগেজে, হ্যাঙ্গার গেটে, বোর্ডিং ব্রিজ প্রভৃতি উপায়ে স্বর্ণের বার চোরাচালান হয়ে আসছে হরহামেশা। একই সঙ্গে বৈধ পথে ঘোষণা দিয়ে স্বর্ণ আমদানি বেড়েছে।
গত এক মাসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেড় টন স্বর্ণবার এনেছেন প্রবাসীরা। এসব প্রবাসীর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক। এসব সোনার বার চোরাচালান হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরমধ্যে অবৈধপথে স্বর্ণ আনতে গিয়ে আটকও হচ্ছে রেকর্ড পরিমাণে। গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৫০০ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাচার হয়ে আসা স্বর্ণ ধরা পড়ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত স্বর্ণ ধরা পড়ছে, তার কয়েকগুণ বেশি স্বর্ণ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর এসব স্বর্ণ চোরাচালানে নেওয়া হচ্ছে নিত্য-নতুন কৌশল ও পদ্ধতির আশ্রয়। চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ থেকে স্বর্ণ এনে বাংলাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বাজারে সরবরাহ করছে। যাত্রীবেশী বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, দেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির উপরের হ্যান্ডেল, মানিব্যাগে করে স্বর্ণ পাচারের ঘটনা ঘটছে।
স্বর্ণবারের ওপর কালো অথবা সিলভারের প্রলেপ দিয়েও পাচারের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কখনো কখনো। রোগী সেজে হুইল চেয়ারে, উরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমর বন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে করে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে লুকিয়ে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটায় করে, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতর, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতর, মানি ব্যাগের ভেতর ও গলায় স্বর্ণের চেইনের সঙ্গে ঝুঁলিয়ে লকেট হিসেবে আনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১০ তোলা ওজনের একেকটি সোনার বার বিমানবন্দর থেকে বাইরে এনে দিলে চোরাচালানিদের কাছ থেকে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পান যাত্রীরা। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসার সময় বিমানের কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বর্ণ পরিবহনে সহায়তা করেন। বাহকদের হাতে স্বর্ণ ধরিয়ে দেন দুবাইয়ে অবস্থানরত চক্রের প্রধানরা। বাহক সেই স্বর্ণ বিমানের আসনের নিচে, শৌচাগারে বা অন্য কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। পরে কৌশলে সেই স্বর্ণ বের করে বাইরে নিয়ে আসা হয়।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। নিয়মিতই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, আগে অনেক বড় বড় চালান আসত। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে বর্তমানে আগের চাইতে বড় চালানগুলো আসা বন্ধ হয়েছে। তারপরও অসাধু কারবারিরা কৌশলে স্বর্ণ আনার চেষ্টা করছে। তাদের গ্রেপ্তারেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন বলে জানান তিনি।
গত ১ নভেম্বর শাহ আমানত বিমানবন্দরে দুবাইফেরত এক যাত্রী আটক হন ৮২টি সোনার বারসহ। কক্সবাজারে বাসিন্দা এনামুল ফিরছিলেন বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে। এর আগের মাসে ১৫ অক্টোবর দুবাইফেরত বাংলাদেশ বিমানের আরেকটি ফ্লাইটের তিনটি আসনে নিচে আটটি প্যাকেটে ১৬০টি সোনার বার উদ্ধার করে চট্টগ্রামের কাস্টমস কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ধরাপড়া চালানগুলোর বেশিরভাগই দুবাই থেকে আসা বিমানের ভেতর ও বিমানের যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া।
শাহ আমানত বিমানবন্দর কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, নভেম্বর মাসে এ বিমানবন্দর দিয়ে ৯৩ হাজার ৬৭০ ভরির সমপরিমাণ ৯ হাজার ৩৬৭টি সোনার বার এসেছে, কেজির হিসাবে যার পরিমাণ ১ হাজার ৯২ কেজি বা এক টনের বেশি। অর্থাৎ এক বছরে সোনা ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ সোনা আমদানি করেছেন, তার চেয়ে ৪৩ গুণ বেশি সোনা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে এক মাসে এনেছেন প্রবাসীরা। একই সঙ্গে গত এক মাসে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণে স্বর্ণবার এনেছেন প্রবাসীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশ থেকে যারা সোনার বার নিয়ে আসছেন, তাদের বেশিরভাগই প্রবাসী শ্রমিক। একেকজন শ্রমিকের পক্ষে ২০ ভরি ওজনের বা প্রায় ১২ লাখ টাকা দামের সোনার বার আনার বিষয়টি তাদের জীবনযাপন ও আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এসব সোনার বার চোরাচালান হয়ে প্রতিবেশী দেশে যাচ্ছে বা অবৈধ লেনদেনে ব্যবহার হচ্ছে।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই সময়ে যাত্রীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বিপুল পরিমাণ সোনা আনার ঘটনা অস্বাভাবিক। সোনা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকতে পারে, তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
শুল্ক বেশি থাকায় লাইসেন্স পাওয়ার পরও ছয় মাস সোনা আমদানি করেননি ব্যবসায়ীরা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা হয়। প্রতি ভরি সোনা আমদানিতে বর্তমানে ২ হাজার টাকা সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়। ব্যাগেজ রুলসেও একই শুল্ক লাগে। শুল্ক কমানোর পর ১০ জুন ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড ১১ হাজার গ্রাম সোনা আমদানির জন্য আবেদন করে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অনাপত্তিও দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দুবাই থেকে ৩০ জুন সোনার বার আমদানি করে নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি।
পরে অরোসা গোল্ড করপোরেশন ১৫ হাজার গ্রাম সোনা আমদানি করে। প্রথম চালান আনার পরপরই ২০ হাজার গ্রাম বা ১ হাজার ৭১৪ ভরি সোনা আমদানির জন্য ঢাকা ব্যাংকের মাধ্যমে আবেদন করে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। সেই আবেদনের ২০ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি হওয়া সোনার মান যাচাইয়ে জাহাজীকরণের আগে ও পরে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চায়।
ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড সেসবের জবাব দিলেও অনাপত্তি পায়নি। এদিকে গত ৩ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সোনা আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজীকরণের প্রাক্কালে সরবরাহকারী প্রান্তে ও দেশে আসার পর পণ্যের মান যাচাইয়ে সঠিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানতে চাইলে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, নানাভাবে সোনা আমদানি প্রক্রিয়া বিলম্ব করা হচ্ছে। একেক সময় একেকটা বিষয় জানতে চাওয়া হচ্ছে। স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী আবেদনের ১৫ দিনের মধ্যে অনুমতি দেওয়ার বিধান থাকলেও সেটি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
নিউজ লাইট ৭১