ঢাকা ১১:১৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা যানজটমুক্ত রাখতে নির্মাণ হচ্ছে ৫টি মেট্রোরেল

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ১০:৪৫:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৯
  • / 115

ঢাকা মহানগর যানজটমুক্ত করা ও রাজধানীর সঙ্গে আশপাশ জেলার সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে ঢাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৫টি মেট্রোরেল বা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি)। ইতোমধ্যে রাজধানীর উত্তরা (উত্তর) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে। প্রায় ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ৫টি মেট্রোরেলের মধ্যে প্রথম অংশ রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীতে দ্রুতগতির অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৫টি মেট্রোরেলের মধ্যে প্রথম অংশ (এমআরটি-৬) উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। দ্বিতীয় মেট্রোরেল (এমআরটি-১) উত্তরা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হবে দুটি অংশে। তৃতীয় মেট্রোরেল (এমআরটি-৫) সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৩৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হবে দুটি অংশে। চতুর্থ মেট্রোরেল (এমআরটি-২) গাবতলী থেকে কাঁচপুর সেতু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হবে। পঞ্চম মেট্রোরেল (এমআরটি-৪) রাজধানীর কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এই ৫টি মেট্রোরেল নির্মাণ হলে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় যানজট নিরসন হবে বলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন ও সক্ষমতা বাড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫টি মেট্রোরেলের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এসব মেট্রোরেলের রুটের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণের পাশাপাশি পাতাল মেট্রোরেলও নির্মাণ করা হবে। এমআরটি লাইন ১, ২, ৪ ও ৫-এ উড়াল পথের পাশাপাশি পাতালরেলপথ নির্মাণ করা হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নগরবাসী পাতালরেলে চড়তে পারবেন। ঢাকার শহরে সব ভবনের ডিজাইন এক রকম নয়। তাই রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে যেসব পয়েন্টে পাতাললাইন হবে, সেখানে ৫০ ফুট মাটির নিচে দিয়ে নির্মাণ কাজ করা হবে। এছাড়া এমআরটি-৬ মতিঝিল বাড়িয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। এমআরটি প্রকল্প ৫টি উল্লেখ করা হলেও মূলত মেট্রোরেলের রুট হবে ৬টি। কারণ এমআরটি-৫ দুটি অংশ সম্পূর্ণ আলাদা রুটে নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে অতি অত্যাধুনিক একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে বলে জানান তিনি।

এমআরটি-৬ : রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালসড়কের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলছে। এর পরোটাই হবে উড়ালপথে। মাটির ১৩ মিটার উপর দিয়ে এই রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইনের পাশে শব্দনিরোধক দেয়াল নির্মাণ করা হবে। এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় ৮টি প্যাকেজে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রথম মেট্রোরেল। ১ নম্বর প্যাকেজের আওতায় দিয়াবাড়ী এলাকায় ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। গত বছরের জানুয়ারিতে এর কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ করা হচ্ছে প্যাকেজ ২-এর আওতায়। এর মধ্যে ডিপোয় ট্রেন রাখার স্থান, ট্রেন মেরামত ও মালপত্রের গুদাম, প্রধান ওয়ার্কশপসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। প্যাকেজ-৩ ও ৪-এর আওতায় উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেলপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। উভয় প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়েছে। এছাড়া আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৮ দশমিক ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ এবং স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে প্যাকেজ-৫ ও ৬-এর অধীন। এই পথে পাইলিং ও পিয়ার তৈরির কাজ চলছে। প্রকল্পের বৈদ্যুতিক এবং মেকানিক্যাল সিস্টেম বাস্তবায়ন হচ্ছে ৭ নম্বর প্যাকেজের আওতায়। রেলের কোচ এবং ডিপোর যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ হচ্ছে প্যাকেজ ৮-এর অধীন। ইতোমধ্যে প্রথম মেট্রোরেলের সামনের ও পেছনের নকশা এবং বাইরের রঙ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

এমআরটি লাইন-১ : দেশের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড বা পাতালরেল হবে এটি। ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লাইনের দুটি অংশ রয়েছে। এর একটি বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। এই লাইনে স্টেশন সংখ্যা হবে ১২। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর। নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত অপর লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। এই লাইনে ৯টি স্টেশনের মধ্যে রয়েছে নতুনবাজার, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স হাউসিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল সেক্টর-৭ ও পূর্বাচল ডিপো। এরই মধ্যে এই রুটের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ বিভিন্ন সার্ভে শেষ হয়েছে। মূল নকশা প্রণয়নের ৭০ শতাংশ কাজও সম্পন্ন হয়েছে। এ রুটের নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালের মধ্যে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। রুটের একটি অংশের ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি গত ২৯ মে জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর) : ২০২৮ সালের মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ (আন্ডারগ্রাউন্ড ১৩ দশমিসক ৫০ কিলোমিটার এবং এলিভেটেড ৬ দশমিক ৫০ কিলেমিটার) ও ১৪ স্টেশনের (৯টি আন্ডারগ্রাউন্ড এবং পাঁচটি এলিভেটেড) মেট্রোরেল নির্মাণে ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের জন্য জাইকার সঙ্গে ৭ হাজার ৩৫৮ মিলিয়ন ইয়েন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ রুট নির্মাণে ব্যয় হবে ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের রুট হলো হেমায়েতপুর-বালিয়ারপুর-মধুমতি-আমিনবাজার-গাবতলী-দারুস সালাম-মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান-২-নতুনবাজার ও ভাটারা।

এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ) : ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত পাতালরেল ও উড়ালরেলের সমন্বয়ে ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার পথ ও ১৬ স্টেশনের মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ও ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার এলিভেটেড নির্মাণ হবে। মোট স্টেশনের মধ্যে ১২টি আন্ডারগ্রাউন্ড ও চারটি এলিভেটেড নির্মাণ করা হবে। চলতি বছরের মার্চে এর সমীক্ষা শেষ হয়েছে। এ রুটের শ্রেণীবিন্যাস হচ্ছে, গাবতলী-টেকনিক্যাল-কল্যাণপুর-শ্যামলী-কলেজ গেট-আসাদ গেট-রাসেল স্কয়ার-পান্থপথ-সোনারগাঁও মোড়-হাতিরঝিল-নিকেতন-রামপুরা-আফতাবনগর-পশ্চিম আফতাবনগর সেন্টার-আফতাবনগর পূর্ব ও দাশেরকান্দি। প্রকল্প নির্মাণের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৩ কোটি টাকা।

এমআরটি লাইন-২ : ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৫ জুন জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক সই হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাপান-বাংলাদেশের অংশগ্রহণে ইতোমধ্যে অন্তত তিনটি প্ল্যাটফর্ম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এর সম্ভাব্য রুট হলো গাবতলী-বসিলা-মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড-সাতমসজিদ রোড-ঝিগাতলা-ধানমন্ডি ২ নম্বর রোড-সায়েন্স ল্যাব-নিউমার্কেট-নীলক্ষেত-আজিমপুর-পলাশী-শহীদ মিনার-ঢাকা মেডিকেল কলেজ-পুলিশ হেডকোয়াটার্স-গোলাপশাহ মাজার-বঙ্গভবনের উত্তরপাশে সড়ক-মতিঝিল-আরামবাগ-কমলাপুর-মুগদা-মা-া-ডেমরা হয়ে চট্টগ্রাম রোড।

এমআরটি লাইন-৪ : ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্র্যাকের নিচ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতালরেল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৯ মার্চ জাপান ও বাংলাদেশ সরকার এবং জাপানের বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্ল্যাটফর্ম সভায় ও ১৫ জুন ২০১৭ জাপান-বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় পিপিপি পদ্ধতিতে এই লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, মেট্রোরেল ১-এর কাজও আমরা হাতে নিয়েছি। প্রায় ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুটে থাকছে দুটি অংশ। প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত। দ্বিতীয় অংশ পূর্বাচল রুট। তা নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত। বিমানবন্দর রুটে ২০ কিলোমিটার বাংলাদেশের প্রথম পাতালরেল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল নির্মিত হতে যাচ্ছে। ২০৩০ সালনাগাদ মেট্রোরেলের ৫টি রুটের কাজ শেষ হবে। তখন যানজটের ভোগান্তি অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ২০ কিলোমিটার এমআরটি লাইন ১-এর কাজ শীঘ্রই শুরু করা যাবে। এ রুটেই দেশের প্রথম পাতালরেল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল করা হবে। এর খরচ হবে পদ্মা সেতু ও এমআরটি লাইন ৬-এর খরচের সমান।

Tag :

শেয়ার করুন

ঢাকা যানজটমুক্ত রাখতে নির্মাণ হচ্ছে ৫টি মেট্রোরেল

আপডেট টাইম : ১০:৪৫:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

ঢাকা মহানগর যানজটমুক্ত করা ও রাজধানীর সঙ্গে আশপাশ জেলার সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে ঢাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৫টি মেট্রোরেল বা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি)। ইতোমধ্যে রাজধানীর উত্তরা (উত্তর) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে। প্রায় ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ৫টি মেট্রোরেলের মধ্যে প্রথম অংশ রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজধানীতে দ্রুতগতির অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

৫টি মেট্রোরেলের মধ্যে প্রথম অংশ (এমআরটি-৬) উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। দ্বিতীয় মেট্রোরেল (এমআরটি-১) উত্তরা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হবে দুটি অংশে। তৃতীয় মেট্রোরেল (এমআরটি-৫) সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৩৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হবে দুটি অংশে। চতুর্থ মেট্রোরেল (এমআরটি-২) গাবতলী থেকে কাঁচপুর সেতু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হবে। পঞ্চম মেট্রোরেল (এমআরটি-৪) রাজধানীর কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এই ৫টি মেট্রোরেল নির্মাণ হলে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় যানজট নিরসন হবে বলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন ও সক্ষমতা বাড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫টি মেট্রোরেলের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এসব মেট্রোরেলের রুটের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণের পাশাপাশি পাতাল মেট্রোরেলও নির্মাণ করা হবে। এমআরটি লাইন ১, ২, ৪ ও ৫-এ উড়াল পথের পাশাপাশি পাতালরেলপথ নির্মাণ করা হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নগরবাসী পাতালরেলে চড়তে পারবেন। ঢাকার শহরে সব ভবনের ডিজাইন এক রকম নয়। তাই রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে যেসব পয়েন্টে পাতাললাইন হবে, সেখানে ৫০ ফুট মাটির নিচে দিয়ে নির্মাণ কাজ করা হবে। এছাড়া এমআরটি-৬ মতিঝিল বাড়িয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। এমআরটি প্রকল্প ৫টি উল্লেখ করা হলেও মূলত মেট্রোরেলের রুট হবে ৬টি। কারণ এমআরটি-৫ দুটি অংশ সম্পূর্ণ আলাদা রুটে নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে অতি অত্যাধুনিক একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে বলে জানান তিনি।

এমআরটি-৬ : রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালসড়কের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলছে। এর পরোটাই হবে উড়ালপথে। মাটির ১৩ মিটার উপর দিয়ে এই রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইনের পাশে শব্দনিরোধক দেয়াল নির্মাণ করা হবে। এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় ৮টি প্যাকেজে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রথম মেট্রোরেল। ১ নম্বর প্যাকেজের আওতায় দিয়াবাড়ী এলাকায় ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। গত বছরের জানুয়ারিতে এর কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ করা হচ্ছে প্যাকেজ ২-এর আওতায়। এর মধ্যে ডিপোয় ট্রেন রাখার স্থান, ট্রেন মেরামত ও মালপত্রের গুদাম, প্রধান ওয়ার্কশপসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। প্যাকেজ-৩ ও ৪-এর আওতায় উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেলপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। উভয় প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়েছে। এছাড়া আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৮ দশমিক ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ এবং স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে প্যাকেজ-৫ ও ৬-এর অধীন। এই পথে পাইলিং ও পিয়ার তৈরির কাজ চলছে। প্রকল্পের বৈদ্যুতিক এবং মেকানিক্যাল সিস্টেম বাস্তবায়ন হচ্ছে ৭ নম্বর প্যাকেজের আওতায়। রেলের কোচ এবং ডিপোর যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ হচ্ছে প্যাকেজ ৮-এর অধীন। ইতোমধ্যে প্রথম মেট্রোরেলের সামনের ও পেছনের নকশা এবং বাইরের রঙ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

এমআরটি লাইন-১ : দেশের প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড বা পাতালরেল হবে এটি। ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লাইনের দুটি অংশ রয়েছে। এর একটি বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। এই লাইনে স্টেশন সংখ্যা হবে ১২। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর। নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত অপর লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। এই লাইনে ৯টি স্টেশনের মধ্যে রয়েছে নতুনবাজার, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স হাউসিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল সেক্টর-৭ ও পূর্বাচল ডিপো। এরই মধ্যে এই রুটের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ বিভিন্ন সার্ভে শেষ হয়েছে। মূল নকশা প্রণয়নের ৭০ শতাংশ কাজও সম্পন্ন হয়েছে। এ রুটের নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালের মধ্যে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। রুটের একটি অংশের ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি গত ২৯ মে জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর) : ২০২৮ সালের মধ্যে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ (আন্ডারগ্রাউন্ড ১৩ দশমিসক ৫০ কিলোমিটার এবং এলিভেটেড ৬ দশমিক ৫০ কিলেমিটার) ও ১৪ স্টেশনের (৯টি আন্ডারগ্রাউন্ড এবং পাঁচটি এলিভেটেড) মেট্রোরেল নির্মাণে ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে। প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের জন্য জাইকার সঙ্গে ৭ হাজার ৩৫৮ মিলিয়ন ইয়েন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ রুট নির্মাণে ব্যয় হবে ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের রুট হলো হেমায়েতপুর-বালিয়ারপুর-মধুমতি-আমিনবাজার-গাবতলী-দারুস সালাম-মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান-২-নতুনবাজার ও ভাটারা।

এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ) : ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত পাতালরেল ও উড়ালরেলের সমন্বয়ে ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার পথ ও ১৬ স্টেশনের মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ও ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার এলিভেটেড নির্মাণ হবে। মোট স্টেশনের মধ্যে ১২টি আন্ডারগ্রাউন্ড ও চারটি এলিভেটেড নির্মাণ করা হবে। চলতি বছরের মার্চে এর সমীক্ষা শেষ হয়েছে। এ রুটের শ্রেণীবিন্যাস হচ্ছে, গাবতলী-টেকনিক্যাল-কল্যাণপুর-শ্যামলী-কলেজ গেট-আসাদ গেট-রাসেল স্কয়ার-পান্থপথ-সোনারগাঁও মোড়-হাতিরঝিল-নিকেতন-রামপুরা-আফতাবনগর-পশ্চিম আফতাবনগর সেন্টার-আফতাবনগর পূর্ব ও দাশেরকান্দি। প্রকল্প নির্মাণের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২৩ কোটি টাকা।

এমআরটি লাইন-২ : ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৫ জুন জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক সই হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাপান-বাংলাদেশের অংশগ্রহণে ইতোমধ্যে অন্তত তিনটি প্ল্যাটফর্ম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এর সম্ভাব্য রুট হলো গাবতলী-বসিলা-মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড-সাতমসজিদ রোড-ঝিগাতলা-ধানমন্ডি ২ নম্বর রোড-সায়েন্স ল্যাব-নিউমার্কেট-নীলক্ষেত-আজিমপুর-পলাশী-শহীদ মিনার-ঢাকা মেডিকেল কলেজ-পুলিশ হেডকোয়াটার্স-গোলাপশাহ মাজার-বঙ্গভবনের উত্তরপাশে সড়ক-মতিঝিল-আরামবাগ-কমলাপুর-মুগদা-মা-া-ডেমরা হয়ে চট্টগ্রাম রোড।

এমআরটি লাইন-৪ : ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্র্যাকের নিচ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতালরেল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৯ মার্চ জাপান ও বাংলাদেশ সরকার এবং জাপানের বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্ল্যাটফর্ম সভায় ও ১৫ জুন ২০১৭ জাপান-বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় পিপিপি পদ্ধতিতে এই লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, মেট্রোরেল ১-এর কাজও আমরা হাতে নিয়েছি। প্রায় ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুটে থাকছে দুটি অংশ। প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত। দ্বিতীয় অংশ পূর্বাচল রুট। তা নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত। বিমানবন্দর রুটে ২০ কিলোমিটার বাংলাদেশের প্রথম পাতালরেল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল নির্মিত হতে যাচ্ছে। ২০৩০ সালনাগাদ মেট্রোরেলের ৫টি রুটের কাজ শেষ হবে। তখন যানজটের ভোগান্তি অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ২০ কিলোমিটার এমআরটি লাইন ১-এর কাজ শীঘ্রই শুরু করা যাবে। এ রুটেই দেশের প্রথম পাতালরেল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল করা হবে। এর খরচ হবে পদ্মা সেতু ও এমআরটি লাইন ৬-এর খরচের সমান।