ঢাকা ১১:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে অনেক অভিযোগ

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৮:৩৪:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • / 121

নিউজ লাইট ৭১: ঢাকা ওয়াসার লাইনের পানি সরাসরি পানে নির্ভরতা কমিয়ে আসায় জার ও বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বছরে বছরে ব্যবসার প্রসার ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে গোটা দেশের মানুষ একসময় বাণিজ্যিক পানির ওপর শতভাগ নির্ভর হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি ১০০ ভাগ সুপেয়, দাবি করে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেছেন, বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংক অপরিষ্কার থাকায় সেখানে প্রায় ৪০ ভাগ পানি দূষিত হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ থাকায় পান করা তো দূরের কথা, রান্নার কাজেও সরাসরি পানি ব্যবহার করেন না রামপুরার বাসিন্দা আলেয়া বেগম। তার মতো ঢাকার হাজারও মানুষ ওয়াসার পানি ফুটিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন।

যদি শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে এরকম অনেক অভিযোগ। তবে ওয়াসার পানি পরীক্ষা করে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা যে তথ্য উপস্থাপন করে, তাও উদ্বেগজনক।

কিন্তু বাধ্য হয়ে নগরবাসী পান করছে দূষিত পানি। সেখানে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরের নাগরিকরা ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নানাভাবে শোধন করে ব্যবহার করলেও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

রাজধানীর মিরপুর, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মালিবাগ, বাড্ডা ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানিতে মাঝেমধ্যেই প্রকট দুর্গন্ধ থাকে। যদিও এসব অভিযোগ বরাবরই উড়িয়ে দেয় ঢাকা ওয়াসা।

জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার লাইনের পানির দুর্গন্ধে গত ১০ বছরে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা পেতে নগরবাসী নির্ভর করছে জার ও বোতলজাত পানির ওপর। এতে বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। ঢাকায় প্রতিদিন জার ও বোতলজাত পানি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯৫ লাখ লিটার।

নিরাপদ ও সুস্থ থাকতে বেশি দামে ক্রেতারা এ পানি কিনছে। মিনারেল ওয়াটার পানকারী মানুষের সংখ্যা বাড়লেও ঢাকায় পানিবাহিত রোগে বাড়ছে। মূলত ওয়াসার পানির ওপর মানুষের নির্ভরতা কমে যাওয়ায় জার ও বোতলজাত পানির বিক্রি বাড়ছে। তবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের দাবি করেন ওয়াসার পানি ১০০% সুপেয়।

তাকসিম এ খান বেসরকারি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে ল্যাব টেস্টে পাওয়া গেছে- ওয়াসার পানিতে কোনো সমস্যা নেই, ভাঙা লাইনের কারণে ১২% থেকে ১৩% পানি দূষিত হয় এবং শেষ একটি স্ট্যাডিতে পাওয়া গেছে ৬% থেকে ১৫% পর্যন্ত ওয়াসার পানি বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দূষিত হচ্ছে। বাকি ৮৫% থেকে ৯৬% পর্যন্ত পানি কোনো দূষিত হচ্ছে না।

ওয়াসার লাইনের পানি গ্রাহকের বাসায় যাওয়ার আগপর্যন্ত এমন গুণগত মান ঠিক থাকে। পাইপ লাইন থেকে বাড়ির জলাধারে (পানি রাখার জায়গা) পানি সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে একটি স্ট্যাডিতে প্রায় ৪০% দূষিত বস্তু জলাধারে পাওয়া গেছে। কাজেই বাড়িতে পানি রাখার জলাধার পরিষ্কার রাখলে প্রায় ১০০% ভাগ বিশুদ্ধ পানি গ্রাহকরা পাবেন বলে মনে করছেন ওয়াসার এমডি।

তাকসিম এ খান বলেন, প্রথমত- ঢাকা ওয়াসা পানি ব্যবস্থাপনা এবং পয়ঃব্যবস্থাপনা দুটো কাজ করে থাকে। সেখানে ১৯৬৩ সালে পানি ব্যবস্থাপনার যাত্রা করে এবং বর্তমানে ১০০% পানি সরবরাহ করতে পারছি। প্রথম চ্যালেঞ্জে ১০০% পানি দেয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারে পানি উত্তোলন করছি, আর সারফেস ওয়াটার মাত্র ২৫% বা ৩০%, যা পরিবেশবান্ধব নয়।

এ কারণে আমরা ২০০৯ সালে একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেই, যা ঢাকা ওয়াসাকে পরিপূর্ণভাবে রি-সাফল করার। এটি ছিলো ঘুরে দাঁড়ানো ঢাকা ওয়াসা কর্মসূচি। কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ‘পরিবেশবান্ধব টেকসই ও গণমুখী ব্যবস্থাপনা’ করা।

কারণ সুপেয় পানি দিতে হলে আগে ব্যবস্থাপনাটা ঠিক করতে হবে। কাজেই আমাদের সেটাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, যেটা নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে আমরা কাজ করছি। তো বর্তমানের অবস্থাটা কি- আমাদের ২০১৩ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে ১০০% ভাগ পানি সরবরাহ করতে পারছি। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় পানি থাকছে এবং সবাই পানি পাচ্ছে।

যদি এই পানির ৭৫% ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। কাজেই সেই ক্ষেত্রে আমরা এখন যাচ্ছি সারফেস ওয়াটারে। যেটা বিরাট কর্মযজ্ঞ, অর্থাৎ নদীর পানিকে শোধন করা। এটির জন্য বড় বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে। আশা করছি ২০২১ বা ২০২২ সালে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।

এতে ৭০ ভাগ সারফেস ওয়াটারে যাওয়া যাবে এবং ৩০ ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পাব। এটি সেই সময়ের জন্য পরিবেশবান্ধব হবে। সেটাই হবে টেকসই, ঢাকা শহরের সকল মানুষ পানি পাবে।

ওয়াসার এমডি আরও বলেন, পানি যেখান থেকে উৎপন্ন হয় সেখানে ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ দেয়ার আগ পর্যন্ত ১০০ ভাগ সুপেয় থাকে। কারণ আমরা যেখানে পানি উৎপন্নকরী সেটা হলো পানি শোধনাগার। পানি শোধনাগার থেকে যখন পানিটা বের হয় তখন ল্যাবে টেস্ট হয়ে বের হয় ১০০% সুপেয়।

সুপেয় অর্থটা ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে সুপেয় পানির বা বাংলাদেশের হিসেবে ৬টি প্যারামিটার রয়েছে। এ ৬টি প্যারামিটার যদি পানিটা গ্রহণযোগ্য হয় তাহলেই সেই পানিকে আমরা বলবো পানযোগ্য।

আরেকটা জায়গা হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পানি উত্তোলনে সমস্যা নেই, তাহলে সমস্যাটা হচ্ছে যখন ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কে যায়, কারণ ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক পাইপ পুরোনো পাইপ, এসব পাইপ বিভিন্ন সময়ে ভেঙে যাওয়ায় লিকেজ হওয়ার কারণে সেখান থেকে ময়লা বা পানি দূষিত হতে পারে। এজন্য ঢাকা শহরে ১০০% পুরানো পাইপ পরিবর্তন করছে ঢাকা ওয়াসা।

গত বছর সুপেয় পানির দাবিতে আন্দোলন, এমনকি ওয়াসা ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করে রাজধানীবাসী। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি ছিলো; রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি সুপেয়। এরপর গত জুলাইয়ে হাইকোর্ট ওয়াসার পানির মান পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।

ওই কমিটি আদালতে ওয়াসার পানির মান-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদন বলছে, ওয়াসার দাবি ঠিক নয়। একাধিক জায়গা থেকে পানির নমুনা পরীক্ষা করে এ কমিটি। এতে ক্ষতিকর ই-কোলাই ও ব্যাকটেরিয়ার সত্যতা মিলে।

দেশে মানুষের প্রতিদিন সুপেয় পানির যে চাহিদা রয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সেই চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। পানির স্তর নিচে নামার সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সাথে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ।

সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ায় মানুষকে ভূ-উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গ্রামের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বিকল্প হিসেবে নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিলের পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ওই পানি ব্যবহারযোগ্য নয়। এসব পানি পান করে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

ঢাকা ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে টিআইবির ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় দাবি করতেই পারে কিন্তু যারা ওয়াসার গ্রাহক তাদের তথ্যানুযায়ী ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ রয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে ওয়াসার বক্তব্যের কোনো মিল নেই।

সারা ঢাকা শহরের মানুষ ওয়াসার পানি নিয়ে আন্দোলন করেছে, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। জন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হয়ে জনগণের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করে না।

এতে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার পানির গুণগতমান বজায় না থাকায় কারণে জার ও বোতলজাত পানি পান করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। ওয়াসার পানি গুণগতমান সম্পন্ন যদি পর্যাপ্ত হতো তাহলে পানি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর এতো প্রসার ঘটতো না।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষা নিয়ে দুটি প্রতিবেদনের ওপর বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি সুপেয়, দাবি করে সংস্থাটির দেয়া বক্তব্য অসত্য বলে হাইকোর্টে বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন দাখিল করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে ছিলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. জহিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এবিএম বদরুজ্জামান।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ সাঈদ উর রহমানের স্বাক্ষরিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসার পানি সুপেয়, সংস্থাটির এমন দাবি অসত্য। ওয়াসার পানিতে মিলেছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও মলের জীবাণু।

Tag :

শেয়ার করুন

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে অনেক অভিযোগ

আপডেট টাইম : ০৮:৩৪:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২০

নিউজ লাইট ৭১: ঢাকা ওয়াসার লাইনের পানি সরাসরি পানে নির্ভরতা কমিয়ে আসায় জার ও বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বছরে বছরে ব্যবসার প্রসার ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে গোটা দেশের মানুষ একসময় বাণিজ্যিক পানির ওপর শতভাগ নির্ভর হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি ১০০ ভাগ সুপেয়, দাবি করে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেছেন, বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংক অপরিষ্কার থাকায় সেখানে প্রায় ৪০ ভাগ পানি দূষিত হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ থাকায় পান করা তো দূরের কথা, রান্নার কাজেও সরাসরি পানি ব্যবহার করেন না রামপুরার বাসিন্দা আলেয়া বেগম। তার মতো ঢাকার হাজারও মানুষ ওয়াসার পানি ফুটিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন।

যদি শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে এরকম অনেক অভিযোগ। তবে ওয়াসার পানি পরীক্ষা করে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা যে তথ্য উপস্থাপন করে, তাও উদ্বেগজনক।

কিন্তু বাধ্য হয়ে নগরবাসী পান করছে দূষিত পানি। সেখানে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরের নাগরিকরা ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নানাভাবে শোধন করে ব্যবহার করলেও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

রাজধানীর মিরপুর, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মালিবাগ, বাড্ডা ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানিতে মাঝেমধ্যেই প্রকট দুর্গন্ধ থাকে। যদিও এসব অভিযোগ বরাবরই উড়িয়ে দেয় ঢাকা ওয়াসা।

জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার লাইনের পানির দুর্গন্ধে গত ১০ বছরে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা পেতে নগরবাসী নির্ভর করছে জার ও বোতলজাত পানির ওপর। এতে বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। ঢাকায় প্রতিদিন জার ও বোতলজাত পানি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯৫ লাখ লিটার।

নিরাপদ ও সুস্থ থাকতে বেশি দামে ক্রেতারা এ পানি কিনছে। মিনারেল ওয়াটার পানকারী মানুষের সংখ্যা বাড়লেও ঢাকায় পানিবাহিত রোগে বাড়ছে। মূলত ওয়াসার পানির ওপর মানুষের নির্ভরতা কমে যাওয়ায় জার ও বোতলজাত পানির বিক্রি বাড়ছে। তবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের দাবি করেন ওয়াসার পানি ১০০% সুপেয়।

তাকসিম এ খান বেসরকারি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে ল্যাব টেস্টে পাওয়া গেছে- ওয়াসার পানিতে কোনো সমস্যা নেই, ভাঙা লাইনের কারণে ১২% থেকে ১৩% পানি দূষিত হয় এবং শেষ একটি স্ট্যাডিতে পাওয়া গেছে ৬% থেকে ১৫% পর্যন্ত ওয়াসার পানি বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দূষিত হচ্ছে। বাকি ৮৫% থেকে ৯৬% পর্যন্ত পানি কোনো দূষিত হচ্ছে না।

ওয়াসার লাইনের পানি গ্রাহকের বাসায় যাওয়ার আগপর্যন্ত এমন গুণগত মান ঠিক থাকে। পাইপ লাইন থেকে বাড়ির জলাধারে (পানি রাখার জায়গা) পানি সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে একটি স্ট্যাডিতে প্রায় ৪০% দূষিত বস্তু জলাধারে পাওয়া গেছে। কাজেই বাড়িতে পানি রাখার জলাধার পরিষ্কার রাখলে প্রায় ১০০% ভাগ বিশুদ্ধ পানি গ্রাহকরা পাবেন বলে মনে করছেন ওয়াসার এমডি।

তাকসিম এ খান বলেন, প্রথমত- ঢাকা ওয়াসা পানি ব্যবস্থাপনা এবং পয়ঃব্যবস্থাপনা দুটো কাজ করে থাকে। সেখানে ১৯৬৩ সালে পানি ব্যবস্থাপনার যাত্রা করে এবং বর্তমানে ১০০% পানি সরবরাহ করতে পারছি। প্রথম চ্যালেঞ্জে ১০০% পানি দেয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারে পানি উত্তোলন করছি, আর সারফেস ওয়াটার মাত্র ২৫% বা ৩০%, যা পরিবেশবান্ধব নয়।

এ কারণে আমরা ২০০৯ সালে একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেই, যা ঢাকা ওয়াসাকে পরিপূর্ণভাবে রি-সাফল করার। এটি ছিলো ঘুরে দাঁড়ানো ঢাকা ওয়াসা কর্মসূচি। কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ‘পরিবেশবান্ধব টেকসই ও গণমুখী ব্যবস্থাপনা’ করা।

কারণ সুপেয় পানি দিতে হলে আগে ব্যবস্থাপনাটা ঠিক করতে হবে। কাজেই আমাদের সেটাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, যেটা নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে আমরা কাজ করছি। তো বর্তমানের অবস্থাটা কি- আমাদের ২০১৩ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে ১০০% ভাগ পানি সরবরাহ করতে পারছি। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় পানি থাকছে এবং সবাই পানি পাচ্ছে।

যদি এই পানির ৭৫% ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। কাজেই সেই ক্ষেত্রে আমরা এখন যাচ্ছি সারফেস ওয়াটারে। যেটা বিরাট কর্মযজ্ঞ, অর্থাৎ নদীর পানিকে শোধন করা। এটির জন্য বড় বড় প্রজেক্টের কাজ চলছে। আশা করছি ২০২১ বা ২০২২ সালে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।

এতে ৭০ ভাগ সারফেস ওয়াটারে যাওয়া যাবে এবং ৩০ ভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পাব। এটি সেই সময়ের জন্য পরিবেশবান্ধব হবে। সেটাই হবে টেকসই, ঢাকা শহরের সকল মানুষ পানি পাবে।

ওয়াসার এমডি আরও বলেন, পানি যেখান থেকে উৎপন্ন হয় সেখানে ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ দেয়ার আগ পর্যন্ত ১০০ ভাগ সুপেয় থাকে। কারণ আমরা যেখানে পানি উৎপন্নকরী সেটা হলো পানি শোধনাগার। পানি শোধনাগার থেকে যখন পানিটা বের হয় তখন ল্যাবে টেস্ট হয়ে বের হয় ১০০% সুপেয়।

সুপেয় অর্থটা ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে সুপেয় পানির বা বাংলাদেশের হিসেবে ৬টি প্যারামিটার রয়েছে। এ ৬টি প্যারামিটার যদি পানিটা গ্রহণযোগ্য হয় তাহলেই সেই পানিকে আমরা বলবো পানযোগ্য।

আরেকটা জায়গা হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে পানি উত্তোলনে সমস্যা নেই, তাহলে সমস্যাটা হচ্ছে যখন ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কে যায়, কারণ ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক পাইপ পুরোনো পাইপ, এসব পাইপ বিভিন্ন সময়ে ভেঙে যাওয়ায় লিকেজ হওয়ার কারণে সেখান থেকে ময়লা বা পানি দূষিত হতে পারে। এজন্য ঢাকা শহরে ১০০% পুরানো পাইপ পরিবর্তন করছে ঢাকা ওয়াসা।

গত বছর সুপেয় পানির দাবিতে আন্দোলন, এমনকি ওয়াসা ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করে রাজধানীবাসী। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি ছিলো; রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি সুপেয়। এরপর গত জুলাইয়ে হাইকোর্ট ওয়াসার পানির মান পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।

ওই কমিটি আদালতে ওয়াসার পানির মান-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদন বলছে, ওয়াসার দাবি ঠিক নয়। একাধিক জায়গা থেকে পানির নমুনা পরীক্ষা করে এ কমিটি। এতে ক্ষতিকর ই-কোলাই ও ব্যাকটেরিয়ার সত্যতা মিলে।

দেশে মানুষের প্রতিদিন সুপেয় পানির যে চাহিদা রয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সেই চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। পানির স্তর নিচে নামার সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সাথে নলকূপে উঠে আসছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও দূষিত পদার্থ।

সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ায় মানুষকে ভূ-উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। গ্রামের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বিকল্প হিসেবে নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিলের পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ওই পানি ব্যবহারযোগ্য নয়। এসব পানি পান করে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

ঢাকা ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে টিআইবির ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় দাবি করতেই পারে কিন্তু যারা ওয়াসার গ্রাহক তাদের তথ্যানুযায়ী ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ রয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে ওয়াসার বক্তব্যের কোনো মিল নেই।

সারা ঢাকা শহরের মানুষ ওয়াসার পানি নিয়ে আন্দোলন করেছে, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। জন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হয়ে জনগণের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করে না।

এতে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার পানির গুণগতমান বজায় না থাকায় কারণে জার ও বোতলজাত পানি পান করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। ওয়াসার পানি গুণগতমান সম্পন্ন যদি পর্যাপ্ত হতো তাহলে পানি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর এতো প্রসার ঘটতো না।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষা নিয়ে দুটি প্রতিবেদনের ওপর বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। রাজধানীতে সরবরাহ করা ওয়াসার পানি সুপেয়, দাবি করে সংস্থাটির দেয়া বক্তব্য অসত্য বলে হাইকোর্টে বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন দাখিল করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে ছিলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. জহিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমান এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এবিএম বদরুজ্জামান।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ সাঈদ উর রহমানের স্বাক্ষরিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসার পানি সুপেয়, সংস্থাটির এমন দাবি অসত্য। ওয়াসার পানিতে মিলেছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও মলের জীবাণু।