সম্পদ জব্দ হচ্ছে সম্রাট-শামীম-খালেদের
- আপডেট টাইম : ০৯:৫৩:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৯
- / 64
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীমের সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কোথায় কোথায় তাদের জোর-দখল করা সম্পদ আছে সেগুলোর তালিকা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) আলাদাভাবে কাজ করছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে জি কে শামীমেরই আছে অন্তত ৯০ একর জমি। এসব জমির মধ্যে বেশিরভাগই সরকারি। ক্ষমতার দাপট ও প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ করে’ এসব জমি দখল করেছেন তিনি। তারা আরও জানান, সম্রাট ও খালেদের বেশি সম্পদ দেশের বাইরে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ ও ব্যবসা আছে তাদের। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবেও তাদের ব্যবসা আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য গতকাল দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে কারও অবৈধ সম্পদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে আদালতের আদেশক্রমে তা জব্দের বিধান রয়েছে। জব্দ সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি ইউনিটও গঠন করা হয়েছে। ওই ইউনিটকে আরও কার্যকর করার বিষয়ে কাজ করছে দুদক।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা , ক্যাসিনো কারবার ও টেন্ডারবাজি করে সম্রাট, খালেদ ও শামীম কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সরকারি ও নিরপরাধ লোকদের সহায়-সম্পদ দখল করেছেন। পাশাপাশি তারা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তিনি বলেন, ওইসব সম্পদ তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে উদ্ধার করতে আমরা নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি। এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা কাজ শুরু করে দিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে তাদের সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। কয়েকটি টিম ওইসব দেশ ঘুরেও এসেছে। ওইসব দেশে তাদের ব্যবসার পাশাপাশি ফ্ল্যাট-বাড়ি আছে। আদালতের মাধ্যমে এসব সম্পদ জব্দ করা হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারওয়ার-বিন-কাশেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদ ও শামীম রিমান্ডে অনেক তথ্য দিয়েছেন। সম্রাটকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের প্রচুর সহায়-সম্পদ আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
র্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালেদ ও শামীমকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সম্রাটকে যেদিন ধরা হয় সেদিনও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। খালেদ ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া কোম্পানি’র নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার জমা দেওয়ার পর তা ‘নেগোশিয়েট’ করতেন জি কে বিল্ডার্সের সঙ্গে। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের কমিশনের নামে চাঁদার টাকা দিতেন সম্রাট, শামীম ও খালেদ। এ কমিশন তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ও পেশার কতিপয় লোককেও দিতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যাবের এক কর্মকর্তা শামীম ও খালেদ রিমান্ডে থাকার সময় সম্পদের ব্যাপারে বিশদ তথ্য দিয়েছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান ও বিদেশে অঢেল সম্পদ আছে তাদের। সম্রাটেরও একই অবস্থা। তারা জোর করে অন্যের বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জায়গা দখল করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, ক্যাসিনো কারবার ও টেন্ডারবাণিজ্য করতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে হয়েছে তাদের। তারা বিদেশে অর্থ পাচার করার কথাও স্বীকার করেছেন। এসব চিহ্নিত করে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। কাকরাইলে ভূঁইয়া ম্যানশন ভবনটি প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এতদিন সম্রাট ও তার লোকজন ভবনটি দখল করে রেখেছিলেন। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যুবলীগ নেতা আরমান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগ নেতা বাদল, খোরশেদ আলম, নুরুন্নবী ওরফে রাজু, শাহজাহানপুরের অংকুর, শাহাদৎ, সেন্টু, ফকিরাপুলের খায়রুল ও গুলিস্তানের শাহাবুদ্দিনের সৌদি আরবের রিয়াদ, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও থাইল্যান্ডে ব্যবসা আছে। খালেদ ও সম্রাট থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও দুবাইতে বেশি অর্থ পাচার করেছেন। ব্যাংকক ও মালয়েশিয়ার পাতায়ায় তাদের তিনটি হোটেল ও তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। দুবাইতে সম্রাট, শামীম ও খালেদের মোটর পার্টস ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা আছে। সিঙ্গাপুরে প্রায় ১২ কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন খালেদ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, শামীমের সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে ব্যবসা আছে। সিঙ্গাপুুরে দুটি ফ্ল্যাট আছে। বান্দরবানে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের সামনে জি কে শামীমের সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার রয়েছে। ৬০ একর জায়গায় রিসোর্টটি করা হয়েছে। জমির কিছু অংশ শামীম কিনেছেন। তবে বেশিরভাগই সরকারি জায়গা এবং তা দখলে নিয়েছেন। ওই জায়গার পাশেই বান্দরবান জেলা পুলিশের একটি ফাঁড়ি তৈরির জন্য ১৮ শতাংশ জমি ‘উপহার’ দিয়েছেন শামীম। স্থানীয়দের অভিযোগ, রিসোর্টের নামে তিনি ৫০ একর জমি দখল করেছেন। প্রতি একর জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৭ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ৩০ একর খাসজমি দখল করেছেন শামীম। এসব কাজে প্রশাসনকে সবসময় ব্যবহার করতেন তিনি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা ‘অনলাইন ক্যাসিনোর রাজা’ হিসেবে পরিচিত সেলিম প্রধান নারায়ণগঞ্জের ভুলতা-গোলাকান্দাইল এলাকায় ১৫ শতাংশ সরকারি জমি দখল করে ব্যবসায়িক কর্মকা- চালিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি জায়গাটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। সেলিমের মতোই সম্রাট, শামীম ও খালেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। অবৈধ সম্পদগুলো আদালতের মাধ্যমে সরকারের হেফাজতে নেওয়া হবে। আর যেগুলো তাদের কেনা সেগুলোও আদালতের নির্দেশে বাজেয়াপ্ত বা সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্রাট ও তার স্ত্রী শারমিন চৌধুরীর মালিকানাধীন মেসার্স শারমিন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স হিশ মুভিস ও প্রিন্সিপাল রিয়েল স্টেটের নামে এফডিআর, ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট ও ক্রেডিট কার্ডগুলো জব্দ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শামীমের মালিকানার মেসার্স জি কে বিল্ডার্স, জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড নামের ব্যাংক হিসাব, শামীমের স্ত্রী শামীমা সুলতানার ব্যাংক হিসাব, খালেদের মেসার্স অর্পণ প্রোপার্টিজের ব্যাংক হিসাবও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়াকুন্ডে এলাকায় সম্রাটের বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাছাড়া খালেদ ও শামীমের একটি করে ফ্ল্যাট আছে। সিঙ্গাপুর শহরেও তাদের ফ্ল্যাট রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের আরেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০০২ সালে মালয়েশিয়া সরকার বিদেশিদের জন্য এমএম২এইচ নামে একটি প্রকল্প চালু করে। সেখানে বলা হয়, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে অন্য দেশের নাগরিকরা মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাট-বাড়ি করে বসবাসের সুবিধা পাবেন। এজন্য তাদের ৫ লাখ রিংগিত (বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি টাকা) মালয়েশিয়া সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার পাশাপাশি মাসে ১০ হাজার রিংগিত দিতে হয়। বিনিময়ে ওই দেশের সরকার যেকোনো দেশের নাগরিককে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দেয়। সেই সুবিধা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা ও সন্ত্রাসীরা নিচ্ছেন।