পুরুষ বন্ধ্যাত্বের কারণ ও প্রতিকার
- আপডেট টাইম : ০৫:২২:৪২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / 93
৭১: পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ হলো পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন শুক্রাণু তৈরি না করতে পারা, এই জন্য সন্তানের আশায় অনেক দম্পতিকেই উদ্বিগ্ন দেখি আমরা। অনেককে শেষ পর্যন্ত হতাশ হতে হয়। সন্তান না হওয়ার দায়টা আমাদের সমাজে নারীর ওপরই বর্তায়। তবে এতে পুরুষ সঙ্গীর ভূমিকাও অনেক সময় প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষদের সমস্যার কারণে সন্তান হয় না। আজ পুরুষ বন্ধ্যাত্ব নিয়ে বিশেষ কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ও দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য সম্পাদক ও প্রকাশক ডা. এম এম মাজেদ।
তিনি তার কলামে লিখেন— বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি মিলিলিটার বীর্যে দেড় কোটি বা তার বেশি শুক্রাণু থাকাটাই সুস্থতার লক্ষণ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা আঁটোসাঁটো অন্তর্বাসের বদলে বক্সার জাতীয় ঢিলেঢালা অন্তর্বাসেই এই সুস্থতা ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে করছে।
সমপ্রতি ৬৫৬ জন ১৮ থেকে ৫৬ বছর বয়সি সুস্থ পুরুষদের নিয়ে একটি গবেষণা চালান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। প্রত্যেকেরই রক্ত ও শুক্রাণুর নমুনা নেয়া হয় ও অন্তর্বাস সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নোত্তর চলে।
সমপ্রতি তাদের হিউম্যান রিপ্রোডাকশন জার্নালে প্রকাশিত হয় এই গবেষণার রিপোর্ট। তাতে দেখা গেছে, শুক্রাণুর সংখ্যা বা ঘনত্ব দুই ক্ষেত্রেই যে ৩৪৫ জন পুরুষ বক্সার জাতীয় অন্তর্বাস বা ঢিলেঢালা অন্তর্বাস পরেন, তাদের ফলাফল বেশি ভালো।
কেমন তা গবেষণায় প্রকাশ, এই ৩৪৫ জনের শুক্রাণুর সংখ্যা অন্যদের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। পিতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যতম জরুরি বিষয় শুক্রাণু ঘনত্ব। সেটিও এই ৩৪৫ জনের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশেরও বেশি ছিলো।
সক্রিয় শুক্রাণুও ছিলো অন্যদের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। আর সারা বিশ্বেই পুরুষের বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসেবে অন্তর্বাসের আদৌ কোনো ভূমিকা আছে কি-না জানতে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই গবেষণার প্রধান লিডিয়া মিনগুয়েজ-অ্যালারসিয়ন জানান, সন্তান না হওয়ার কারণ খুঁজতে বসলে জানা যায়, প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষরাও দায়ী থাকেন।
অন্য কোনো অসুখ বা যৌনরোগ না থাকলেও সুস্থ পুরুষদের মধ্যেও আজকাল এই বন্ধ্যাত্বের প্রবণতা বাড়ছে। জীবনযাপনের কোনো কোনো ভুল এই অসুখকে বাড়িয়ে তুলছে, তা দেখতেই এমন গবেষণা।
তবে এই ধরনের গবেষণার সীমাবদ্ধতাও আছে। অন্তর্বাসের কাপড় ঠিক কেমন হওয়া উচিত বা একটানা কতক্ষণ অন্তর্বাস পরা বন্ধাত্বের সমস্যা ঠেকাতে কার্যকর, এমন কোনো তথ্য এখনই উঠে আসেনি গবেষণায়। তবে তা সত্ত্বেও এই গবেষণা এই সংক্রান্ত অসুখ নিরাময়ে নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
তার মতে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এই গবেষণাটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এত বেশি মানুষের ওপর এমন গবেষণা আগে কখনো হয়নি। তবে খুব আঁটোসাঁটো অন্তর্বাস শরীরে ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (এফএসএইচ) ক্ষরণে বাধা দেয়।
ফলে এর প্রভাবে শুক্রাণু কমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। ৩০-৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে শুক্রাশয়ের গুণগত ত্রুটি, ১০-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে শুক্রাণু বেরোনোর পথে প্রতিবন্ধকতার কারণে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। ১-৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হরমোনজনিত সমস্যার কারণে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। পিটুইটারি গ্রন্থি বা হাইপোথ্যালামাসের সমস্যা এ ক্ষেত্রে অন্যতম দায়ী।
অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে তথ্য গোপন করা হয়। অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা, সংক্রমণ, ধূমপান ও বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, পরিবেশের নানাবিধ দূষণও দায়ী হতে পারে।
এছাড়া শুক্রাশয়ের সংক্রমণ, ফুলে যাওয়া কিংবা জেনেটিক বা ক্রোমোজমাল সমস্যা দেরিতে ধরা পড়ার কারণেও সন্তান না হতে পারে। সন্তান দেরিতে হচ্ছে এমন দম্পতির ক্ষেত্রে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীরও কিছু জরুরি পরীক্ষা করা উচিত।
যেমন- সংক্রমণ, রক্তের শর্করা পরীক্ষা, সিমেন অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে শুক্রাণুর সংখ্যা, আকৃতি, চলনক্ষমতা নির্ণয় ইত্যাদি। অনেক সময় শুক্রাণু চলাচলের নালিটি সংক্রমণ বা আঘাতের কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
জন্মগতভাবেও নালিটি বন্ধ বা অসম্পূর্ণ থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা যায়। পুরুষের হরমোন টেস্টোস্টেরনের অভাব থাকলে প্রয়োজনে ইনজেকশন নিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায়। আগে ভ্যাসেকটমি করা থাকলে পুনঃসংযোগের মাধ্যমে পুরুষের প্রজননক্ষমতা ফিরিয়ে আনা যায়।
মনে রাখতে হবে, জিনগত ও ক্রোমোজোমাল ত্রুটিতে, শুক্রাশয় কোনো কারণে (সংক্রমণ, আঘাত ইত্যাদি) চিরতরে নষ্ট হলে উন্নতির সম্ভাবনা নেই। তবে শুক্রাণুর সংখ্যা, আকার ও চলনক্ষমতার ত্রুটি থাকলে সীমিত পর্যায়ে ভালো ফল আশা করা যেতে পারে। পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগীর পরিপূর্ণ তথ্য ও ইতিহাস জানা।
কিছু পরামর্শ
নিয়মিত ঘুম ও শরীর চর্চা : গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম হলে শুক্রাণুর পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলেও তা গুণগতভাবে দুর্বল হয়। তাই নিয়মিত ঘুম ও শরীরচর্চার অভ্যাস থাকতে হবে। ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে।
ধূমপান বন্ধ : ২০টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা পর্যবেক্ষণ করে ২০১৬ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় ধূমপান শুক্রাণুর পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
চাপ থেকে দূরে থাকুন : যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং যতটুকু সম্ভব চাপ থেকে দূরে থাকতে হবে। এজন্য শরীরচর্চা করুন এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা অনুসরণ করুন। প্রয়োজনে চাপ কমাতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।
ত্যাগ করতে হবে অতিরিক্ত অ্যালকোহল ও মাদকগ্রহণের অভ্যাস : গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালকোহল, মারিজুয়ানা এবং কোকেন শুক্রাণুর উৎপাদন কমিয়ে দেয়। সুতরাং এসব থেকে দূরে থাকতে হবে। এগুলো একেবারে বন্ধ করে দিলে শুক্রাণুর উৎপাদন স্বাভাবিক হবে।
কথা কথায় ওষুধ নয় : কিছু মেডিসিনও পুরুষের বন্ধ্যাত্বকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তাই সচেতনভাবে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। বন্ধ্যাত্ব গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলেও অভিজ্ঞ হোমিও গবেষকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
হোমিওমেডিসিন : প্রাথমিকভাবে লক্ষণের ওপর যেসব মেডিসিন আসতে পারে, অরাম— মিউরন্যাট, বোরাক্স, হেলোনিয়াস, নেট্রামমিউর, কোনিয়াম, থুজা, সালফার, নাক্স, পালছেটিলা, সিপিয়া, লাইকোপোডিয়াম,সিলিনিয়ামসহ আরও অনেক ওষুধ লক্ষণের ওপর আসতে পারে, তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া মেডিসিন নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগ আরও জটিল আকারে পৌঁছতে পারে।
লেখক : কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি