নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক হবে কবে?
- আপডেট টাইম : ১০:৫৩:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪
- / 15
শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর পুলিশ অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং তখন আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটে। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশ অবশ্য বলছে পাঁচই অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়েছে।
কিন্তু তারা এখন মনে করছেন পুলিশ বাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং ঢাকাসহ সারাদেশে পুলিশি কার্যক্রম স্থিতিশীল হওয়ায় এখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
তবে একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধ চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য।
এসব কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে।
যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও র্যাব ছাড়াও সেনাবাহিনী এখনো মাঠে আছে বলে জানানো হয়েছে এবং তারা আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এবার আন্দোলনের সময় সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব ঘটনায় অনেক থানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর হয়েছে। আগের সরকারের সময়ে আলোচিত বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তা আর কাজেই যোগ দেননি।
বেশ কিছু পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়েছে। সাবেক দুই আইজিপিসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মামলায় আটকও করা হয়েছে।
এরপর মধ্যে বাহিনীকে পুনর্গঠন ও কার্যকরী করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি এখনো হয়েছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করেন অনেকে।
কয়েকটি আলোচিত ঘটনা
ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি দোকানে অস্ত্রধারীদের ঢুকে ডাকাতি ও এক তরুণীকে চাপাতি হাতে দৌড়ানোর ঘটনাসহ একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনার পর এলাকাবাসীর বিক্ষোভের পর শনিবার রাতে সেনাবাহিনীসহ যৌথ-বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে।
ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকার অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম এবং প্রকাশ্যে চাপাতি রামদা নিয়ে আক্রমণ কিংবা দৌড়াদৌড়ির মতো বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে।
বিশেষ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানা হেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন বা মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছে- এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ।
সাম্প্রতিক এই দুটি ঘটনাই মোহাম্মদপুর এলাকার। ওই এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খলিল বলছেন, পাঁচই অগাস্টের পর কয়েকদিন ছিলো ডাকাতির আতঙ্ক আর এখন কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধ ভাবে কিশোর-তরুণরা ঘুরাঘুরি করছে, একে ওকে হামলা করছে এবং ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না।
এর আগে গত ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতির ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরা ডাকাতেরা নিজেদের যৌথ-বাহিনী বলে পরিচয় দিয়ে নগদ ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করেছিলো বলে ওই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছিলেন। এ ঘটনায় আটজনকে আটক করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে কিশোর গ্যাং আর ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিলো এলাকাটি। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শনিবার বিকেলে থানার সামনে বিক্ষোভে ও ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়ার পর শনিবার রাতে এলাকাজুড়ে অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী।
আবার ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় হামলা, লুটপাট, ডাকাতি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের চর এলাকায় মা ও মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় দুইজনকে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ।
নীলফামারীর সৈয়দপুরে ক্ষুদ্রঋণের ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হতেই ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক ব্যক্তি।
ফরিদপুরে বৃহস্পতিবার রাতে শহরের ব্রাক্ষ্মণকান্দা এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে কনস্টেবলসহ দুজনকে পিটুনি দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই করতে রিফাত মিয়া নামের অটোরিকশাচালককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া গত পাঁচই অগাস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুলিশি ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এরপর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বদলে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের অধিকাংশ এলাকায়।
এই পরিবর্তনের জের ধরে কিছু কিছু এলাকায় প্রতিশোধমূলক ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি দলীয়ভাবে বেশ কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি কেন?
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলছেন, জুলাইয়ের আন্দোলনের সময়ের ভূমিকার কারণে পুলিশ নৈতিক ও মনোবল সংকটে পড়ে অকার্যকর হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছে অপরাধীরা। আবার এখন সমালোচনা কিংবা বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার আশংকায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে এ দুটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক আক্রোশ মেটাতে গিয়ে নানা জায়গায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। নৈতিক ও মনোবল সংকট কাটিয়ে পুলিশ বাহিনীকে পরিপূর্ণ কার্যকর করতে সময় লাগবে।
উল্লেখ্য, পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের আগে থেকেই সারাদেশে হামলার শিকার হতে শুরু করে পুলিশ। সিরাজগঞ্জের একটি থানায় ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া ৫ ও ৬ অগাস্ট দুদিনেই ঢাকায় অন্তত তেরটি থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভাংচুর করা হয় আরও একুশটি থানায়। এসব ঘটনায় শত শত মামলার নথিও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিদায়ের পরপরই সারাদেশে থানা ও পুলিশ স্থাপনাগুলোতে নির্বিচারে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সিনিয়র অফিসারসহ বহু পুলিশ সদস্য পালিয়ে যান। তখন পুলিশের নন ক্যাডার কর্মকর্তা ও সদস্যদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সারাদেশে ৪৫০টি থানা আক্রান্ত হওয়ার তথ্য দেয়া হয়েছিলো।
পরের অন্তত এক সপ্তাহ ঢাকাসহ সারাদেশে পুলিশি ব্যবস্থা ছিলো কার্যত অচল।
ড. তৌহিদুল হক বলছেন, তখন থেকেই পুলিশকে বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে এবং আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে মনোবল সংকটে পড়ে এখনো পূর্ণোদ্দমে কাজ করতে পারছে না তারা।
তিনি বলেন, আমাদের মতো দেশে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ। পুলিশের এমন পরিস্থিতিতে পড়ার সুযোগ নিয়েছে দুটি গোষ্ঠী। একটি পেশাগত অপরাধীরা। আরেকটি হলো ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়া পুলিশের কাজের গতিহীনতা। সমালোচনা বা বিরূপ পরিস্থিতিতে পরার ভয়ে তারা তাৎক্ষণিক অ্যাকশন নিতে পারছে না অনেক ক্ষেত্রে।
যদিও গত ২৪শে সেপ্টেম্বরই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সচিবালয়ে বলেছিলেন যে, পরদিন অর্থাৎ ২৫শে সেপ্টেম্বর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আর কোন অবনতি হতে তারা দেবেন না।
পুলিশ কী বলছে
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এনামুল হক সাগর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সদর দপ্তর থেকে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আইজিপি নিজেই বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন। বাহিনী প্রধান হিসেবে পুলিশি কার্যক্রম গতিশীল করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে গিয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন। এমন নানা উদ্যোগ নিয়ে বাহিনীর কার্যক্রম স্বাভাবিক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পাঁচই অগাস্টের পর কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিলো এবং পুলিশ বাহিনী অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছিলো। এ কারণে অপারেশনাল কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হয়েছিলো বলে জানান তিনি।
“সেগুলো সামাল দিয়ে আমরা এখন পূর্ণোদ্দমে কাজ করছি। কাজের মাধ্যমেই আমরা জনগণের আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনতে চাই। আমরা সেই চেষ্টাই চালাচ্ছি এবং আমরা আশা করি দেশবাসী শিগগিরই সুফল পেতে শুরু করবে। অপরাধ প্রবণতা ও কার্যক্রমও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আর ঢাকা মহানগর পুলিশ বা ডিএমপির মুখপাত্র তালেবুর রহমান বলছেন, নগরীর সব থানা এবং পুলিশি কার্যক্রম এখন পুরোপুরি সক্রিয় ও কার্যকর হয়েছে। সে কারণে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটলেও কেউ অপরাধ করে রেহাই পাবে না এবং নগরবাসী এর সুফল পেতে শুরু করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলার এমন অবনতি হয়েছে কেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটা পট পরিবর্তনের পর কেউ কেউ হয়তো সুযোগ নিতে চেয়েছে এবং সে কারণে কিছু ঘটনা বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে।
তিনি বলেন, কিন্তু আমরা আমাদের পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়ে এসেছি। সে কারণে এখন আর সমস্যা হবে না। কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। শিগগিরই দেখবেন পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
প্রতিবেদন: বিবিসি বাংলা।
নিউজ লাইট ৭১