ঢাকা ০৯:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ও ফেস্টুনে সয়লাব রাজধানী

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ১০:১৯:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • / 303

নিউজ লাইট ৭১: অবৈধভাবে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ও ফেস্টুনে সয়লাব রাজধানী। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র, কাউন্সিল প্রার্থী এবং রেখে ক্ষতাসীন দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীরা এসব অবৈধ বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পোস্টার ও ফেস্টুন সাঁটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাতে নগরীর সৌন্দর্য চাপা পড়ে গেছে।

চলতি বছর ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিব বর্ষ পালিত হবে। সে হিসেবে দেড় মাসেরও কম সময়ের বাকি আছে মুজিব বর্ষ শুরু হতে। মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে সারা দেশকে নানাভাবে সাজানোর কাজ শুরু হলেও খোদ রাজধানী শহর নিয়ে যেন কারও কোনো ভাবনা নাই। সারা শহরজুড়ে অবৈধ বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনের ভরে আছে। এসব আপসারণের দায় যেন কারও নেই। মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে রাজধানী শহর ঢাকাকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সাজানোর দরকার বলে নগর পরিকল্পনাবিদরাও মনে করেন। তাদের মতে, মুজিব র্বষ উপলক্ষে ঢাকাকে আবশ্যই সাজানো উচিৎ। সারা বাংলাদেশকে সাজানো হচ্ছে, সে হিসেবে ঢাকাকেও সাজানো দরকার। পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখা উচিৎ। সরকারের যতগুলো সংস্থা আছে সবাই যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় এবং জনগণকেও যত্মবান হতে হবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেলেও এখনো নির্বাচনী পোস্টার অপসারণ শেষ করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। অন্যদিকে মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা উন্নয়নের বিভিন্ন ফিরিস্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নানান ধরনের বিলবোর্ড, পোস্টার সাঁটিয়েছেন। নিজেদের মুখচ্ছবি-সংবলিত বিলবোর্ড-ব্যানার টানিয়ে নিজেদের পরিচিতির জানান দিচ্ছেন তারা। সিটি কর্পোরেশনের আইন তোয়াক্কা না করেই তারা এসব কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ও নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। যত্রতত্র সেঁটে দেওয়া হয়েছে সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ ও গবেষক প্রফেসর নজরুল ইসলাম গতকাল নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, মুজিব র্বষ উপলক্ষে ঢাকাকে আবশ্যই সাজানো উচিৎ। সারা বাংলাদেশকে সাজানো হচ্ছে, সে হিসেবে ঢাকাকেও সাজানো দরকার। তিনি বলেন, রাজধানী শহরের পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখা উচিৎ। নতুন মেয়ররা আসছেন, তারা এই কাজটা আরও উৎসাহের সাথে করবেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ শহরটাকে স্বাস্থ্যসম্মত, পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ সুন্দর রাখা। এটার জন্য সব রকমের উদ্যোগ নগর কর্তৃপক্ষ তথা বাংলাদেশ সরকারেও নিতে হবে। সরকারের যতগুলো সংস্থা আছে সবাই যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় এবং জনগণকেও এনিয়ে যত্মবান হতে হবে।
এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরো বলেন, সিটি নির্বাচনের সময় পোস্টারে পোস্টারে একেবারে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এ শহরটি। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পোস্টারতো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং বাকিটাও অতি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। সেই সাথে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার, এই পোস্টারগুলো কিভাবে নষ্ট করা যায় বা কাজে লাগানো যায়। সবচেয়ে বড় কথা এই শহরটাকে সুন্দরভাবে সাজানো দরকার। এজন্য সরকারে তেমন একটা বেশি টাকা খরচ হবে বলে আমি মনে করি না। ন্যূনতম ও সবচেয়ে কম খরচে এই শহরটাকে সুন্দর করা যেতে পারে। আমি আশা করি সরকার সেই উদ্যোগ নিবে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর গুলশান-১ থেকে গুলশান-২, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট থেকে শুরু করে পলাশী, আজিমপুর, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, ডেমরা, মুগদা ক্রসিং, শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সামনে, মৎস্য ভবন, শিক্ষা ভবন মোড়, মগবাজার ও মালিবাগ এলাকা সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের বিলবোর্ড-ব্যানারে ছেয়ে গেছে। বিশেষ করে গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবন পর্যন্ত সড়কদ্বীপ ও সড়কের আশেপাশে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রচার সংবলিত বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টেুনে ছেয়ে গেছে।

সিটি নির্বাচন পরবর্তী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন গত রোববার থেকে পোস্টারগুলো অপসারণ শুরু করেছে। এসব পোস্টারের মধ্যে বেশির ভাগই অপচনশীল প্লাস্টিকে লেমিনেটিং করা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পোস্টারগুলো অপসারণ করতে তাদের এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে। কর্মকর্তাদের কাছে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এগুলো মাতুয়াইলের ভাগাড়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) খোঁজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের যারা এগুলো পুনর্ব্যবহার করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লেমিনেটেড পোস্টারগুলো পুরোপুরিভাবে পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় এরই মধ্যে খুলে ফেলা পোস্টারগুলো জঞ্জাল হয়ে আছে। আর কিছু পোস্টারের ঠাঁই হয়েছে খোলা ড্রেনগুলোতে। গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রচারণার জন্য ঢাকার আকাশ অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো পোস্টারে। পরিবেশবিদরা এসব লেমিনেটেড পোস্টার পরবর্তীতে কী হবে তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উচ্চ আদালত ২২ জানুয়ারি লেমিনেটেড পোস্টার তৈরি ও প্রদর্শন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) গত মাসে জানিয়েছিলো নির্বাচনী প্রচারণার কারণে প্রায় দুই হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হবে। ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হোসেন বলেছেন, আমরা নির্বাচনের পরদিন সকাল থেকেই পোস্টারগুলো অপসারণ করতে শুরু করেছি। তবে আমার মনে হয় এটা শেষ করতে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, পোস্টারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু শুধুই কাগজের। যদি ভাঙ্গারি সংগ্রহকারীরা এসব নিয়ে যায় এবং যারা কাগজের ব্যাগ তৈরি করে তাদের কাছে বিক্রি করে তাহলে তা খুবই ভালো হবে।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এএসএম মামুন জানিয়েছেন, তারা গত রোববার ছয়টি এলাকার পোস্টার অপসারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের দুই হাজার ৮৫০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী কাজ করছেন। আশা করি খুব শিগগিরই সব পোস্টার অপসারণ করতে পারবো।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পলিথিন ব্যবহারই নিষিদ্ধ। এই বর্জ্য যেভাবেই রাখা হোক, তা পরিবেশ দূষণ করবেই। এটা সহজে ধ্বংস হয় না। দুর্ভাগ্য, জনগণের যারা প্রতিনিধি, এই নগরের পরিবেশ রক্ষা যারা করেন, তারাই এই নিষিদ্ধ কাজটি দেদারছে করেছেন। ভোট শেষ হয়েছে, এখন এসব পলিথিনের শেষ ঠিকানা রাজধানীর নালা-নর্দমা ও নদী-খাল। এতে একদিকে পানিবদ্ধতা আরও বাড়বে। অন্যদিকে পরিবেশের ভয়ংকর ক্ষতি করবে। পরিবেশবাদীরা আরও বলছেন, পলিথিন মোড়ানো পোস্টার সাঁটানোর কাজটি একটি অপকর্ম। এখান থেকে তো নিস্তার নেই। তাই বাস্তবসম্মত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোস্টারের পলিথিন বর্জ্য অপসারণ করা উচিত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সহসভাপতি ডা. আবদুল মতিন বলেন, পলিথিনের দূষণ রোধের কোনো উপায় নেই। তবে এর পুনর্ব্যবহার কিছুটা পরিত্রাণ মিলতে পারে। এজন্য সরকারের উচিত, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নগরজুড়ে ঝুলে থাকা পোস্টারের পলিথিন যথাযথভাবে অপসারণ করা।

এদিকে গত রোববার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস গত সোমবারের মধ্যে ডিএসসিসি এলাকার সব পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনসহ অন্যান্য প্রচারসামগ্রী সরাতে প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম রফিক আহাম্মেদ বলেন, তিনি জানেন না যে লেমিনেটেড পোস্টারগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য কি না। তিনি আরও জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিষয়টি জানিয়েছি এবং চিঠির অনুলিপি সিটি কর্পোরেশনগুলোতে পাঠিয়েছি। যাতে তারা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোস্টারগুলোর অপসারণের ব্যবস্থা করতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এভাবে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড লাগিয়ে নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করা ঠিক নয়। এটা দেখার জন্য সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। অন্যদিকে এভাবে পরিবেশের জন্য ক্ষতির পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ও লেমিনেটেড পোস্টার ও ব্যানারে প্রচারণাও অবৈধ। তিনি বলেন, এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি সড়কের ডিভাইডার, মোড়, বাসার ছাদ, দেয়াল ও গাছসহ বিভিন্নস্থানে ছোট-বড় বিলবোর্ড বসানো হয়েছে। এর কোনোটি স্টিলের আবার কোনোটি কাঠ দিয়ে তৈরি। রাজধানীর বিভিন্ন সাধারণ ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনের আগে ভোট চেয়ে, সালাম, শুভেচ্ছা ও নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে এসব বিলবোর্ড ব্যবহার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে কোনো বিলবোর্ড স্থাপন করতে হলে সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এসবের বেশির ভাগই অনুমতি ছাড়াই স্থাপন করা হয়েছে। নগরীর অর্ধেকের চেয়ে বেশি বিলবোর্ডই অবৈধ বলে স্বীকার করেছেন উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা। দিনের পর দিন তারা এসব দখল করে অবৈধভাবে নিজেদের প্রচার ও ব্যবসা করে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন মাঝে মধ্যেই এগুলো অপসারণের ঘোষণা দিলেও সরঞ্জাম সঙ্কটে তারা বেশিদূর এগুতে পারে না বলে কর্মকর্তারা স্বীকার করেন।

Tag :

শেয়ার করুন

বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ও ফেস্টুনে সয়লাব রাজধানী

আপডেট টাইম : ১০:১৯:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০

নিউজ লাইট ৭১: অবৈধভাবে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ও ফেস্টুনে সয়লাব রাজধানী। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র, কাউন্সিল প্রার্থী এবং রেখে ক্ষতাসীন দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীরা এসব অবৈধ বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পোস্টার ও ফেস্টুন সাঁটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাতে নগরীর সৌন্দর্য চাপা পড়ে গেছে।

চলতি বছর ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিব বর্ষ পালিত হবে। সে হিসেবে দেড় মাসেরও কম সময়ের বাকি আছে মুজিব বর্ষ শুরু হতে। মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে সারা দেশকে নানাভাবে সাজানোর কাজ শুরু হলেও খোদ রাজধানী শহর নিয়ে যেন কারও কোনো ভাবনা নাই। সারা শহরজুড়ে অবৈধ বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনের ভরে আছে। এসব আপসারণের দায় যেন কারও নেই। মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে রাজধানী শহর ঢাকাকে সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সাজানোর দরকার বলে নগর পরিকল্পনাবিদরাও মনে করেন। তাদের মতে, মুজিব র্বষ উপলক্ষে ঢাকাকে আবশ্যই সাজানো উচিৎ। সারা বাংলাদেশকে সাজানো হচ্ছে, সে হিসেবে ঢাকাকেও সাজানো দরকার। পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখা উচিৎ। সরকারের যতগুলো সংস্থা আছে সবাই যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় এবং জনগণকেও যত্মবান হতে হবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেলেও এখনো নির্বাচনী পোস্টার অপসারণ শেষ করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। অন্যদিকে মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা উন্নয়নের বিভিন্ন ফিরিস্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নানান ধরনের বিলবোর্ড, পোস্টার সাঁটিয়েছেন। নিজেদের মুখচ্ছবি-সংবলিত বিলবোর্ড-ব্যানার টানিয়ে নিজেদের পরিচিতির জানান দিচ্ছেন তারা। সিটি কর্পোরেশনের আইন তোয়াক্কা না করেই তারা এসব কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ও নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। যত্রতত্র সেঁটে দেওয়া হয়েছে সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ ও গবেষক প্রফেসর নজরুল ইসলাম গতকাল নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, মুজিব র্বষ উপলক্ষে ঢাকাকে আবশ্যই সাজানো উচিৎ। সারা বাংলাদেশকে সাজানো হচ্ছে, সে হিসেবে ঢাকাকেও সাজানো দরকার। তিনি বলেন, রাজধানী শহরের পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখা উচিৎ। নতুন মেয়ররা আসছেন, তারা এই কাজটা আরও উৎসাহের সাথে করবেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এ শহরটাকে স্বাস্থ্যসম্মত, পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ সুন্দর রাখা। এটার জন্য সব রকমের উদ্যোগ নগর কর্তৃপক্ষ তথা বাংলাদেশ সরকারেও নিতে হবে। সরকারের যতগুলো সংস্থা আছে সবাই যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয় এবং জনগণকেও এনিয়ে যত্মবান হতে হবে।
এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরো বলেন, সিটি নির্বাচনের সময় পোস্টারে পোস্টারে একেবারে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এ শহরটি। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পোস্টারতো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং বাকিটাও অতি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। সেই সাথে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার, এই পোস্টারগুলো কিভাবে নষ্ট করা যায় বা কাজে লাগানো যায়। সবচেয়ে বড় কথা এই শহরটাকে সুন্দরভাবে সাজানো দরকার। এজন্য সরকারে তেমন একটা বেশি টাকা খরচ হবে বলে আমি মনে করি না। ন্যূনতম ও সবচেয়ে কম খরচে এই শহরটাকে সুন্দর করা যেতে পারে। আমি আশা করি সরকার সেই উদ্যোগ নিবে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর গুলশান-১ থেকে গুলশান-২, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট থেকে শুরু করে পলাশী, আজিমপুর, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, ডেমরা, মুগদা ক্রসিং, শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সামনে, মৎস্য ভবন, শিক্ষা ভবন মোড়, মগবাজার ও মালিবাগ এলাকা সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের বিলবোর্ড-ব্যানারে ছেয়ে গেছে। বিশেষ করে গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবন পর্যন্ত সড়কদ্বীপ ও সড়কের আশেপাশে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রচার সংবলিত বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টেুনে ছেয়ে গেছে।

সিটি নির্বাচন পরবর্তী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন গত রোববার থেকে পোস্টারগুলো অপসারণ শুরু করেছে। এসব পোস্টারের মধ্যে বেশির ভাগই অপচনশীল প্লাস্টিকে লেমিনেটিং করা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পোস্টারগুলো অপসারণ করতে তাদের এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে। কর্মকর্তাদের কাছে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এগুলো মাতুয়াইলের ভাগাড়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) খোঁজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের যারা এগুলো পুনর্ব্যবহার করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লেমিনেটেড পোস্টারগুলো পুরোপুরিভাবে পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় এরই মধ্যে খুলে ফেলা পোস্টারগুলো জঞ্জাল হয়ে আছে। আর কিছু পোস্টারের ঠাঁই হয়েছে খোলা ড্রেনগুলোতে। গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রচারণার জন্য ঢাকার আকাশ অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো পোস্টারে। পরিবেশবিদরা এসব লেমিনেটেড পোস্টার পরবর্তীতে কী হবে তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উচ্চ আদালত ২২ জানুয়ারি লেমিনেটেড পোস্টার তৈরি ও প্রদর্শন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) গত মাসে জানিয়েছিলো নির্বাচনী প্রচারণার কারণে প্রায় দুই হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হবে। ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর জাহিদ হোসেন বলেছেন, আমরা নির্বাচনের পরদিন সকাল থেকেই পোস্টারগুলো অপসারণ করতে শুরু করেছি। তবে আমার মনে হয় এটা শেষ করতে ৮ থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, পোস্টারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু শুধুই কাগজের। যদি ভাঙ্গারি সংগ্রহকারীরা এসব নিয়ে যায় এবং যারা কাগজের ব্যাগ তৈরি করে তাদের কাছে বিক্রি করে তাহলে তা খুবই ভালো হবে।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এএসএম মামুন জানিয়েছেন, তারা গত রোববার ছয়টি এলাকার পোস্টার অপসারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের দুই হাজার ৮৫০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী কাজ করছেন। আশা করি খুব শিগগিরই সব পোস্টার অপসারণ করতে পারবো।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পলিথিন ব্যবহারই নিষিদ্ধ। এই বর্জ্য যেভাবেই রাখা হোক, তা পরিবেশ দূষণ করবেই। এটা সহজে ধ্বংস হয় না। দুর্ভাগ্য, জনগণের যারা প্রতিনিধি, এই নগরের পরিবেশ রক্ষা যারা করেন, তারাই এই নিষিদ্ধ কাজটি দেদারছে করেছেন। ভোট শেষ হয়েছে, এখন এসব পলিথিনের শেষ ঠিকানা রাজধানীর নালা-নর্দমা ও নদী-খাল। এতে একদিকে পানিবদ্ধতা আরও বাড়বে। অন্যদিকে পরিবেশের ভয়ংকর ক্ষতি করবে। পরিবেশবাদীরা আরও বলছেন, পলিথিন মোড়ানো পোস্টার সাঁটানোর কাজটি একটি অপকর্ম। এখান থেকে তো নিস্তার নেই। তাই বাস্তবসম্মত ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোস্টারের পলিথিন বর্জ্য অপসারণ করা উচিত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সহসভাপতি ডা. আবদুল মতিন বলেন, পলিথিনের দূষণ রোধের কোনো উপায় নেই। তবে এর পুনর্ব্যবহার কিছুটা পরিত্রাণ মিলতে পারে। এজন্য সরকারের উচিত, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নগরজুড়ে ঝুলে থাকা পোস্টারের পলিথিন যথাযথভাবে অপসারণ করা।

এদিকে গত রোববার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস গত সোমবারের মধ্যে ডিএসসিসি এলাকার সব পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনসহ অন্যান্য প্রচারসামগ্রী সরাতে প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

যোগাযোগ করা হলে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম রফিক আহাম্মেদ বলেন, তিনি জানেন না যে লেমিনেটেড পোস্টারগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য কি না। তিনি আরও জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিষয়টি জানিয়েছি এবং চিঠির অনুলিপি সিটি কর্পোরেশনগুলোতে পাঠিয়েছি। যাতে তারা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোস্টারগুলোর অপসারণের ব্যবস্থা করতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এভাবে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড লাগিয়ে নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করা ঠিক নয়। এটা দেখার জন্য সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। অন্যদিকে এভাবে পরিবেশের জন্য ক্ষতির পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ও লেমিনেটেড পোস্টার ও ব্যানারে প্রচারণাও অবৈধ। তিনি বলেন, এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি সড়কের ডিভাইডার, মোড়, বাসার ছাদ, দেয়াল ও গাছসহ বিভিন্নস্থানে ছোট-বড় বিলবোর্ড বসানো হয়েছে। এর কোনোটি স্টিলের আবার কোনোটি কাঠ দিয়ে তৈরি। রাজধানীর বিভিন্ন সাধারণ ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনের আগে ভোট চেয়ে, সালাম, শুভেচ্ছা ও নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে এসব বিলবোর্ড ব্যবহার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে কোনো বিলবোর্ড স্থাপন করতে হলে সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এসবের বেশির ভাগই অনুমতি ছাড়াই স্থাপন করা হয়েছে। নগরীর অর্ধেকের চেয়ে বেশি বিলবোর্ডই অবৈধ বলে স্বীকার করেছেন উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা। দিনের পর দিন তারা এসব দখল করে অবৈধভাবে নিজেদের প্রচার ও ব্যবসা করে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন মাঝে মধ্যেই এগুলো অপসারণের ঘোষণা দিলেও সরঞ্জাম সঙ্কটে তারা বেশিদূর এগুতে পারে না বলে কর্মকর্তারা স্বীকার করেন।