কোটি কোটি টাকা হরিলুট
- আপডেট টাইম : ০৫:৪৫:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুন ২০২২
- / 31
২৩ জুন রাত আটটা। চট্টগ্রাম মহানগরের দেওয়ানহাট সিএসডি (কেন্দ্রীয় খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্র) থেকে সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বোঝাই ট্রাক বেড়িয়ে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০ গজ দূরত্বের গাজী ফিলিং স্টেশনে। এরপরই গালাবব্ধ ত্রিপল খুলে ট্রাক থেকে পর পর ৪/৫ বস্তা চাল নামিয়ে নেয় ওই ট্রাক চালকসহ আরও কয়েকজন। বিষয়টি প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গড়িয়ে পরে চালক, চালকের সহকারী ও খাদ্যবোঝাই ট্রাক আপোষে ছাড়া পায় রাত সাড়ে বারটায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এদিনের এ ঘটনা এখানে নতুন কিছু নয়! এভাবে এ ফিলিং স্টেশনে প্রতিনিয়ত সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল চুরি সিণ্ডিকেট। যার সাথে জড়িত রয়েছেন ওই সিএসডির দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা এবং ট্রাক চালক।
ট্রাক চালকের ভাষ্য, সিএসডির শ্রমিক নেতারা প্রতি ৫০ কেজি বস্তা চাল তিনশ টাকা দরে বিক্রি করেন ট্রাক চালকদের কাছে। আর ট্রাক চালকরা তা বাহিরে নিয়ে বিক্রি করছেন হাজার বারশ টাকায়। এভাবে প্রতিদিনই বস্তা বস্তা চাল হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে নির্ধারিত চালের আড়তে।
তবে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কর্মকর্তা ও খাদ্য পরিহরন ঠিকাদাররা জানালেন এ সিএসডি থেকে শুধুমাত্র ইনভয়েস আদান-প্রদানে রাস্ট্রীয় কোষাগাড় লুটের ঘটনা।
দায়িত্বশীল এ কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিনই নগরের দেওয়ান হাট ও হালিশহরের দুই সিএসডি (কেন্দ্রীয় সরবরাহ কেন্দ্র) থেকে সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির বরাদ্দকৃত চাল নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে ছোট বড় অনেক কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক। একইভাবে গম বের হয় নগরের পতেঙ্গার এলাকার সাইলো থেকে। তবে এসব খাদ্যশস্যের নির্ধারিত গন্তব্যে (সরকারি গুদাম থেকে গুদামে) না পৌঁছিয়ে ডিও (বরাদ্দপত্র) মূলে কব্জায় নিয়ে নেয় চট্টগ্রামের একাধিক সংঘবব্ধ সিণ্ডিকেট। আর এর বিপরীতে শুধুমাত্র ইনভয়েস (চলাচল পত্র) চালাচালিতে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতি বছর পরিবহন খরচ বাবদ লুট হয় কোটি কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বরাদ্দকৃত এসব খাদ্যশস্য পার্বত্য বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির। যা সংশ্লিষ্টরা গোপনে এসব ব্যবসায়িদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ডিও (বরাদ্দপত্র) মূলে বিক্রি করে দেয়। পরে স্থানীয় জেলা ও উপজেলার খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিবহন ঠিকাদার ও ব্যবসায়ি সিণ্ডিকেট গোপন আঁতাতে
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, সরকারের এসব চাল নিয়ে চট্টগ্রামে এক সময় শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক সিণ্ডিকেট লুটপাটে মেতে ছিলো। পরে এ সিণ্ডিকেটে যোগ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সংস্থাটির শীর্ষ আরও অনেক কর্তা। যারা কাগজে-পত্রে খাদ্য পরিবহন দেখিয়ে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতি অর্থবছরের সমাপ্তিতে চট্টগ্রামে দেওয়ানহাট ও হালিশহরে অবস্থিত দুই সিএসডি থেকে চাল (সিদ্ধ ও আতপ) এবং নগরের পতেঙ্গা সাইলো থেকে গম পাচার এধরনের উৎসবে পরিনত হয়।
খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, দেশে সরকারি ভাবে আমদানি করা খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে প্রান্তিক কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকেও খাদ্যশস্য ক্রয় করে সরকার। এসব খাদ্যশস্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটে রয়েছে কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম। একইভাবে গম মজুদে নগরের পতেঙ্গায় রয়েছে সাইলো। পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্যসহায়তা চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ করে থাকে। এ জন্য দূরত্ব আর যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনা করে ঠিকাদারদের মাইলপ্রতি পরিবহন ভাড়া দেয় খাদ্য বিভাগ। প্রতিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বছরে একাজে আয় করে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা।
যদিও এই বিষয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত বলে দাবী করেছেন নগরের দেওয়ানহাট সিএসডির ব্যবস্থাপক হাসান জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, বরাদ্দপত্র অনুযায়ি খাদ্যশস্য ট্রাক বোঝাইকরে পরিহরন ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব। খাদ্যবোঝাই ট্রাক সিএসডির গেইট থেকে বেরুলেই তার পুরো দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পরিবহন ঠিকাদারের।
হাসান জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, সিএসডি থেকে চাল চুরির কোনো সুযোগ নেই। গেইটের বাহিরে যায় কিছু হোক তার দায় দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায় না।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম’র মোবাইলে বেশ কয়েকবার কল এবং হোয়াটসঅ্যাপে টেক্স পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য মিলেনি।
নিউজ লাইট ৭১