ঢাকা ০৮:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধানের গোলা

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ১১:০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২১
  • / 39

ফরিদপুর থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধানের গোলা। এক কালে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের বাড়িতে এরকম ধানের গোলার প্রচলন ছিলো। গোলাভরা ধান ছিলো। পুকুর ভরা মাছ ছিল।

জমিদারি প্রথা ও কৃষক পরিবারের বিভিন্ন ঐতিহ্যর মধ্যে ছিল এই ধানের গোলা। এখন মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুদ করার জন্য বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরী ঐতিহ্য বহন করা ধানের গোলা। অথচ এক সময়ে সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করতো কার ক’টি ধানের গোলা আছে এই হিসেব কষে। কন্যা পাত্রস্থ করতেও বর পক্ষের লোকজন আগে দেখতো ধানের গোলা। নতুন প্রজন্মের কাছে এটা একটা ইতিহাস। শুধু রুপকথার গল্পের মতো। আর প্রবীণ ও পুরনোদের কাছে এটি শুধু হারিয়ে যাওয়া একটি ঐতিহ্য।

সরেজমিনে জানা গেছে, গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারের সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন আর ফরিদপুরের কোথাও নেই। পুরো জেলার মধ্যে একটি মাত্র ধানের গোলা এখনও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে কৃষক অধির কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে এটি অবস্থিত। তার মাঠের যতো ধান এই গোলাতেই তিনি রাখেন। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বাড়ির উঠানে এখনো তিনি এই ধানের গোলাটি যত্ন করে রেখেছেন। আগেকার দিনের মতো ব্যবহার করছেন।

অধীর কুমার বিশ্বাস বলেন, এককালে এই রকমের ধানের গোলা কৃষক ও বিভিন্ন মানুষ-পরিবারে ছিল। কিন্তু এখন আর কোথাও নেই। ফরিদপুর জেলার মধ্যে আমার বাড়িতে একটি মাত্র ধানের এই গোলাটি আছে। তাও এর বয়স হয়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ বছর। গোলাটিতে একশত মনের উপরে ধান রাখা যায়। আমার নিজের জমির যতো ধান হয়, রাখার উপযোগী করে তা এই গোলাতেই রাখি। বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে এসেছি। অনেক যত্ন করে ব্যবহার করা হয় এবং মাঝে মাঝে সংস্কার করে পুরনো ঐতিহ্যটি টিকিয়ে রেখেছি। ধানের মৌসুমে ধান কেটে শুকিয়ে গোলায় রাখা হয়। প্রয়োজনের সময় গোলা থেকে ধান বের করে পুনরায় রোদে শুকিয়ে ধান ভাঙানো হয়।

অধীর কুমার বলেন, আগের কার সময়ে নামকরা গেরস্থ বলতে- মাঠ ভরা বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর কৃষকের গোলা ভরা ধানকেই বুঝাতো। এখন আর আগের মতো কেউ এভাবে ধান রাখে না। বস্তায় করে গোডাউন অথবা ঘরের মধ্যে রেখে দেন।

তিনি আরও বলেন, প্রথমে বাঁশ-কঞ্চি দিয়ে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হয়। এঁটেল মাটির কাদা তৈরি করে ভেতরে ও বাইরে আস্তরণ লাগিয়ে উপরে টিনের চালা দিয়ে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা এই ধানের গোলা। প্রবেশপথ বেশ ওপরে, যেন চোর বা ডাকাত সহজে ধান নিতে না পারে। এই ধরনের ধানের গোলায় ইঁদুরও ঢুকে ক্ষতি করতে পারে না। গোলায় শুকানো ভেজা ধানের চাল শক্ত হয়। তখনকার কৃষকদের কাছে এটিই ছিলো ধান রাখার আদর্শ পন্থা। এখনও অনেক লোক এসে জানতে চান উঠোনের উপর এটা কি?

উপজেলা সদরের সদরদি গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সজীব মোল্লা তিনি ফরিদপুর সিটি পেজের মডারেটর হিসেবে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেন, কিন্তু ধানের গোলা এর আগে কখনো দেখেননি,চিনতেনও না।তিনি জানান, আমার গ্রামের পাশেই কৃষ্ণনগর গ্রামে পুরনো ঐতিহ্যবাহী একটি মাত্র ধানের গোলার অবস্থান তা-ও এতোদিনে জানতে বা চিনতে পারিনি। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটা চেনা তো দুরে থাক রুপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

মধুখালী উপজেলার মেকচামী ইউনিয়নের বামুন্দী গ্রামের বাসিন্দা ও প্রবীণ শিক্ষক প্রভাষ মন্ডল জানান, এখন আর গোলার প্রচলন বা কদর কোনটাই নেই। এখন এটা চোখেও পড়ে না। ড্রাম-বস্তায়ই ধান রাখা হয়। বোয়ালমারী উপজেলা সদর এলাকার বাসিন্দা, সাংস্কৃতিক কর্মী আমীর চারু, সুমন খানসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, এখন আর এসব চোখে পড়ে না। একেবারেই বিলুপ্ত। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন সেই গোলা নির্মাণশ্রমিকদের দেখা তো দুরে থাক, কোথাও সন্ধান মিলে না।

কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী হাসান ফিরোজ ও সমর চক্রবর্তী বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে দেখেছি ও শুনেছি গোলায় ধান রাখা কৃষকের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। অন্য জেলায় কিছু কিছু দেখা গেলেও জানা মতে ফরিদপুরে নেই। গোলাগুলো এককালে আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য বহন করতো।

সালথা, সদরপুর, নগরকান্দা, ভাঙ্গা এলাকার একাধিক প্রবীণরা জানান, আগের দিনে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এ ধরনের ধানের গোলা থাকত। তবে এখন আর নেই। নাতি-নাতনিদের কাছে বললে তারা বিশ্বাসও করতে চায় না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধানের গোলা। বর্তমানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কালের কলের নাঙলে ওলট পালট করে দিয়েছে গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সেসব চালচিত্র। শুধু ধানের গোলা নয়, ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা সংস্কৃতি।

এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. হযরত আলী জানান, কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্ত। আশির দশকের দিকে ওই সব ধানের গোলা কৃষক ও সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতো। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে মানুষের পারিবারিক ব্যবহার্য উপকরণে। ফলে ঐতিহ্যবাহী এসব ধানের গোলার জায়গা দখল করে নিয়েছে পাটের বস্তা। এগুলো তৈরি ঝামেলামুক্ত ও সহজে বাজারে পাওয়া যায় বলে মানুষ বাঁশের গোলার পরিবর্তে এসব আধুনিক উপকরণ ব্যবহারে  অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে হারিয়ে গেছে বাঁশের গোলার কদর। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তালিকায় এর অবস্থান শূন্য রয়েছে বলেও তিনি আরও জানান।

নিউজ লাইট ৭১

 

Tag :

শেয়ার করুন

বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধানের গোলা

আপডেট টাইম : ১১:০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

ফরিদপুর থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধানের গোলা। এক কালে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের বাড়িতে এরকম ধানের গোলার প্রচলন ছিলো। গোলাভরা ধান ছিলো। পুকুর ভরা মাছ ছিল।

জমিদারি প্রথা ও কৃষক পরিবারের বিভিন্ন ঐতিহ্যর মধ্যে ছিল এই ধানের গোলা। এখন মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুদ করার জন্য বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরী ঐতিহ্য বহন করা ধানের গোলা। অথচ এক সময়ে সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করতো কার ক’টি ধানের গোলা আছে এই হিসেব কষে। কন্যা পাত্রস্থ করতেও বর পক্ষের লোকজন আগে দেখতো ধানের গোলা। নতুন প্রজন্মের কাছে এটা একটা ইতিহাস। শুধু রুপকথার গল্পের মতো। আর প্রবীণ ও পুরনোদের কাছে এটি শুধু হারিয়ে যাওয়া একটি ঐতিহ্য।

সরেজমিনে জানা গেছে, গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারের সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন আর ফরিদপুরের কোথাও নেই। পুরো জেলার মধ্যে একটি মাত্র ধানের গোলা এখনও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে কৃষক অধির কুমার বিশ্বাসের বাড়িতে এটি অবস্থিত। তার মাঠের যতো ধান এই গোলাতেই তিনি রাখেন। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বাড়ির উঠানে এখনো তিনি এই ধানের গোলাটি যত্ন করে রেখেছেন। আগেকার দিনের মতো ব্যবহার করছেন।

অধীর কুমার বিশ্বাস বলেন, এককালে এই রকমের ধানের গোলা কৃষক ও বিভিন্ন মানুষ-পরিবারে ছিল। কিন্তু এখন আর কোথাও নেই। ফরিদপুর জেলার মধ্যে আমার বাড়িতে একটি মাত্র ধানের এই গোলাটি আছে। তাও এর বয়স হয়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ বছর। গোলাটিতে একশত মনের উপরে ধান রাখা যায়। আমার নিজের জমির যতো ধান হয়, রাখার উপযোগী করে তা এই গোলাতেই রাখি। বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে এসেছি। অনেক যত্ন করে ব্যবহার করা হয় এবং মাঝে মাঝে সংস্কার করে পুরনো ঐতিহ্যটি টিকিয়ে রেখেছি। ধানের মৌসুমে ধান কেটে শুকিয়ে গোলায় রাখা হয়। প্রয়োজনের সময় গোলা থেকে ধান বের করে পুনরায় রোদে শুকিয়ে ধান ভাঙানো হয়।

অধীর কুমার বলেন, আগের কার সময়ে নামকরা গেরস্থ বলতে- মাঠ ভরা বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর কৃষকের গোলা ভরা ধানকেই বুঝাতো। এখন আর আগের মতো কেউ এভাবে ধান রাখে না। বস্তায় করে গোডাউন অথবা ঘরের মধ্যে রেখে দেন।

তিনি আরও বলেন, প্রথমে বাঁশ-কঞ্চি দিয়ে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হয়। এঁটেল মাটির কাদা তৈরি করে ভেতরে ও বাইরে আস্তরণ লাগিয়ে উপরে টিনের চালা দিয়ে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা এই ধানের গোলা। প্রবেশপথ বেশ ওপরে, যেন চোর বা ডাকাত সহজে ধান নিতে না পারে। এই ধরনের ধানের গোলায় ইঁদুরও ঢুকে ক্ষতি করতে পারে না। গোলায় শুকানো ভেজা ধানের চাল শক্ত হয়। তখনকার কৃষকদের কাছে এটিই ছিলো ধান রাখার আদর্শ পন্থা। এখনও অনেক লোক এসে জানতে চান উঠোনের উপর এটা কি?

উপজেলা সদরের সদরদি গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সজীব মোল্লা তিনি ফরিদপুর সিটি পেজের মডারেটর হিসেবে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করেন, কিন্তু ধানের গোলা এর আগে কখনো দেখেননি,চিনতেনও না।তিনি জানান, আমার গ্রামের পাশেই কৃষ্ণনগর গ্রামে পুরনো ঐতিহ্যবাহী একটি মাত্র ধানের গোলার অবস্থান তা-ও এতোদিনে জানতে বা চিনতে পারিনি। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে এটা চেনা তো দুরে থাক রুপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

মধুখালী উপজেলার মেকচামী ইউনিয়নের বামুন্দী গ্রামের বাসিন্দা ও প্রবীণ শিক্ষক প্রভাষ মন্ডল জানান, এখন আর গোলার প্রচলন বা কদর কোনটাই নেই। এখন এটা চোখেও পড়ে না। ড্রাম-বস্তায়ই ধান রাখা হয়। বোয়ালমারী উপজেলা সদর এলাকার বাসিন্দা, সাংস্কৃতিক কর্মী আমীর চারু, সুমন খানসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, এখন আর এসব চোখে পড়ে না। একেবারেই বিলুপ্ত। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন সেই গোলা নির্মাণশ্রমিকদের দেখা তো দুরে থাক, কোথাও সন্ধান মিলে না।

কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী হাসান ফিরোজ ও সমর চক্রবর্তী বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে দেখেছি ও শুনেছি গোলায় ধান রাখা কৃষকের জন্য খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। অন্য জেলায় কিছু কিছু দেখা গেলেও জানা মতে ফরিদপুরে নেই। গোলাগুলো এককালে আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য বহন করতো।

সালথা, সদরপুর, নগরকান্দা, ভাঙ্গা এলাকার একাধিক প্রবীণরা জানান, আগের দিনে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এ ধরনের ধানের গোলা থাকত। তবে এখন আর নেই। নাতি-নাতনিদের কাছে বললে তারা বিশ্বাসও করতে চায় না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধানের গোলা। বর্তমানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কালের কলের নাঙলে ওলট পালট করে দিয়েছে গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সেসব চালচিত্র। শুধু ধানের গোলা নয়, ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা সংস্কৃতি।

এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. হযরত আলী জানান, কালের বিবর্তনে আজ বিলুপ্ত। আশির দশকের দিকে ওই সব ধানের গোলা কৃষক ও সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতো। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে মানুষের পারিবারিক ব্যবহার্য উপকরণে। ফলে ঐতিহ্যবাহী এসব ধানের গোলার জায়গা দখল করে নিয়েছে পাটের বস্তা। এগুলো তৈরি ঝামেলামুক্ত ও সহজে বাজারে পাওয়া যায় বলে মানুষ বাঁশের গোলার পরিবর্তে এসব আধুনিক উপকরণ ব্যবহারে  অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে হারিয়ে গেছে বাঁশের গোলার কদর। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তালিকায় এর অবস্থান শূন্য রয়েছে বলেও তিনি আরও জানান।

নিউজ লাইট ৭১