রিকশাচালক থেকে কোটিপতি যুবলীগ নেতা
- আপডেট টাইম : ১০:০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০১৯
- / 222
রাজধানীর কালশী, কুর্মিটোলা ও বাউনিয়া বাঁধ এবং আশপাশ এলাকায় এক আতঙ্কের নাম জুয়েল রানা। পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিহারি ক্যাম্পে
নয়জনকে পুড়িয়ে মারা, মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণ, জমি দখল ও চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, জনৈক প্রভাবশালী এমপির ক্যাডার হিসেবে কাজ করেন জুয়েল। বিভিন্ন মামলায় কয়েক দফা জেলও খেটেছেন তিনি। নিজেও মামলায় ফাঁসিয়েছেন বহু মানুষকে। তবে এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা বলে দাবি করেছেন জুয়েল রানা। তিনি নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ‘একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাউন্সিলর নির্বাচনে প্রার্থী হব। তাই আমার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
কোটিপতি এ যুবলীগ নেতার উত্থান সম্পর্কে স্থানীয়দের ভাষ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে জুয়েল পল্লবী-কালশী এলাকায় রিকশা চালাতেন। তার বাবাও ছিলেন রিকশাচালক। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই দলটির নেতাদের সঙ্গে জুয়েলের সখ্য গড়ে ওঠে। দলটি ক্ষমতার আসার পর রাতারাতি পাল্টে যায় তার ভাগ্য। অনেক রিকশার মালিক বনে যাওয়া জুয়েল কালশী মোড়ে স্কুলের পাশে বসান গ্যারেজ। এক এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পল্লবী থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান তিনি। এরপরই বাউনিয়া বাঁধ, পলাশনগর, রূপনগর, বেগুনটিলা ও লালমাটিসহ আশপাশ এলাকায় সরকারি খাসজমি দখল করে দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। কালশী-বেগুনবাড়ী সংলগ্ন সরকারি জমিতে গড়ে তোলেন ‘রাজু বস্তি’। সেখান থেকে ভাড়াবাবদ তার কাছে আসে মোটা অঙ্কের অর্থ।
তারা আরও জানিয়েছেন, মিরপুর-১১ নম্বরের ‘বি’ ব্লকে ঢাকা শহর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (ডুইপ) পৌনে এক কাঠা আয়তনের কমপক্ষে ১৫টি বাড়ি রয়েছে জুয়েল রানা ও তার স্বজনদের দখলে। কেনার নামে নানা কৌশলে বাড়িগুলো তারা দখল করেছেন। সেগুলো হচ্ছেÑ ৭ নম্বর লাইনের ২১ থেকে ২৪ নম্বর, ৮ নম্বর লাইনের ১৬ থেকে ২২ ও ২৪ এবং ১০ নম্বর লাইনের ১৫ ও ১৬ নম্বর বাড়ি। এছাড়া মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে বাউনিয়া বাঁধ মোড়ে টেম্পোস্ট্যান্ড সংলগ্ন ‘মীম ভিলা’ নামের বাড়িটি করেছেন জুয়েল। এছাড়াও পলাশনগরে তার আছে আরও তিনটি বাড়ি। যুবলীগ নেতা হওয়ার পর গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়িতেও আলিশান ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। যদিও সেটি তার পৈতৃক বাড়ি বলে দাবি জুয়েলের। এছাড়া নেত্রকোনায় আরেকটি বাড়ির তথ্য পাওয়া গেলেও অস্বীকার করেছেন তিনি। সাভারের বিরুলিয়ায় স্ত্রীর নামে বেশকিছু জমি কেনার পাশাপাশি জুয়েল নিজ নামে ও বেনামেও কিনেছেন অনেক জমি। চাঁদাবাজির অর্থ ও দখলের মাধ্যমেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
সরেজমিন বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় দেখা যায়, নতুন রাস্তার এক পাশে জলাশয়ের ওপর শত শত ঘর। পানিতে ডুবে থাকা বাঁশের খুঁটির ওপর কাঠের পাটাতন ও টিনের বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরগুলোর কয়েকটি আবার দোতলা। বাঁধের ‘এ’ ও ‘সি’ ব্লক এবং বাজার রোডের পাশে জলাশয়ের ওপরে এভাবেই গড়ে উঠেছে কলাবাগান ও পুকুরপাড় বস্তিসহ কয়েকটি বস্তি। প্রতিটি বস্তিতে রয়েছে কয়েকশ ঘর। বেশিরভাগ জলাশয়ের ওপরে হলেও কয়েকটি ঘর তৈরি করা হয়েছে ভরাট করে।
এলাকাবাসী বলছেন, বাউনিয়া বাঁধের ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’সহ বিভিন্ন ব্লকে প্রায় দুই হাজারের মতো বস্তিঘর রয়েছে। পাশাপাশি আছে বেশ কয়েকটি দোকান ও গ্যারেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বস্তির অনেক ঘরই ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছেন স্থানীয় এমপির ঘনিষ্ঠ জুয়েল, খলিল, আলতাফ ও তাদের সহযোগীরা। অন্যগুলো থেকে মাসে ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়।
কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা জানান, জুয়েলের নেতৃত্বে বাউনিয়া বাঁধের রাজু বস্তিসহ আশপাশ বস্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয় ক্যাম্প থেকে। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০১৪ সালের ১৪ জুন বিহারি ক্যাম্পে আগুন দেয় জুয়েলের লোকজন। এতে পুড়ে মারা যায় ক্যাম্পের বাসিন্দা ইয়াসিন আলীর স্ত্রী বেবী আক্তার (৪০); যমজ ছেলে লালু ও ভুলু (১৪); তিন মেয়ে শাহানা (২৪), রোখসানা (১৮) ও আফসানা (২০); শাহানার আড়াই বছরের ছেলে মারুফ; ইয়াসিনের বড় ছেলে আশিক (২৫) ও তার স্ত্রী শিখা বেগম (১৮)। ওই নয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার বিচার দাবি করে সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে বিহারিরা। এতে তাদের নেতা সাদাকাত খান ফাক্কু বলেন, ঘটনার স্পষ্ট ভিডিও ফুটেজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। তার ভাষ্য, ওই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জুয়েল রানার ভাই রিপন, চাচাতো ভাই রুবেল, রাজনৈতিক সহযোগী মিলনসহ আরও অনেকে জড়িত ছিল। অথচ তাদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। উল্টো হামলার বিচার চাওয়ায় জুয়েলের নির্দেশে বিহারিদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী ও নিরীহ ক্যাম্পবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেন ৩নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি এমএম বিপ্লব।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মিরপুর এলাকায় জুয়েলের রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এলাকায় মাদক ও জুয়াসহ নানা অবৈধ কাজের নিয়ন্ত্রক তিনি। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন বাউনিয়াবাদ লালমাটি এলাকার সুমন (পেটকাটা সুমন), বাচ্চু, হারুন, হেলু, দিলা, গেসু, জালাল, শাহপরাণ বস্তির মুকুল, বাস্তুহারা লীগের নেতা ফজর আলীসহ যুবলীগের শতাধিক নেতাকর্মী।
পল্লবীর পলাশনগর সড়কঘেঁষা ৬ নম্বর প্লটে সাড়ে পাঁচ কাঠা জমির ওপর দোতলা বাড়িটি দখলের অভিযোগ রয়েছে জুয়েলের বিরুদ্ধে। বাড়িটির অংশীদার মাহবুব হাসান জানান, স্থানীয় স্বপন, রিয়াদ ও বাবুর কাছ থেকে তারা ১২ লাখ টাকা ঋণ করেছিলেন। ওই লেনদেন মেটানোর নামে জুয়েল বাড়িটি দখলের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তিনি ও তার সহযোগীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে সাদা স্ট্যাম্পে তাকে সই করিয়ে নেন। মাহবুবের দাবি, ‘প্রভাব খাটিয়ে জুয়েল রানা আমাদের ২ কোটি টাকার সম্পদ দখল করে নিয়েছেন।’ স্থানীয়দের দাবি, দখল ও চাঁদাবাজির আয়ে বনানীর ডিওএইচএস এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন জুয়েল। নিজে ব্যবহার করেন বিলাসবহুল গাড়ি। এছাড়া স্ত্রী-সন্তানের জন্যও রয়েছে আলাদা গাড়ি।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে বাঁধের ‘ডি’ ব্লকের বাউনিয়া বাঁধ ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী জামেনা আক্তারকে (১৪) ধর্ষণের অভিযোগে পল্লবী থানায় মামলা হয় জুয়েল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। অপমান ও দুঃখে কিশোরটি আত্মহত্যা করে। স্থানীয়দের দাবি, জুয়েল ও তার সহযোগীদের চাপের মুখে বিষয়টি আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হন ওই মামলার বাদী জামেনার মামা আমির হোসেন। এ বিষয়ে তিনি নিউজ লাইট ৭১ কে বলেন, ‘এলাকায় থাকি। বনে থেকে তো আর বাঘের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তাই মামলা আপস করেছি। তবে কারও কাছ থেকে এক পয়সারও সুবিধা নিইনি।’
জুয়েলের ভাষ্য : এসব অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমি কাউকে অন্যায়ভাবে ধমকও দিই না; কারও ওপর অত্যাচার-নির্যাতনও করি না। মাদক বা জুয়ার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। থানায় গিয়ে দেখেন আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ আছে কি না। যুবলীগের কেউ কোনো অন্যায় বা চাঁদাবাজি করলে আমি কঠোরভাবে দমন করি। বিহারি ক্যাম্পে আগুনের সঙ্গে বিন্দু পরিমাণ জড়িত থাকলে আমি এলাকাতেই থাকতে পারতাম না। আমার সম্মানকে নষ্ট করার জন্য একটি মহল এসব অপপ্রচার করছে।’
মাদ্রাসাছাত্রীর ধর্ষণে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি মহল ষড়যন্ত্র করে আমাকে ওই মামলায় আসামি করে। পরে বাদী যখন বুঝতে পেরেছেন, তখন তিনি নিজেই মামলা তুলে নেন।’
ডুইপ প্রকল্পের ১৫টি বাড়ি দখল প্রসঙ্গে জুয়েল বলেন, ‘৭ নম্বর লাইনের ২৪ নম্বর বাসাটি আমার মা-বাবার পৈতৃক সম্পত্তি এবং তা বঙ্গবন্ধুর আমলে বরাদ্দ পাওয়া, ২৩ নম্বর বাসা আমার দাদির নামে, আমার পাঁচ চাচার পাঁচটা। ৮ নম্বর লাইনের ২৪ নম্বর বাড়িটি আমার বাবা তার বন্ধু খালেক চেয়ারম্যান থেকে কিনেছেন। এই লাইনের ২২ নম্বর বাড়ি আমি কিনেছি, এখানে আমার অফিস। সেটা সরকার থেকে ২৬০০ পরিবারকে দিয়েছে। যে বাড়িগুলো উল্লেখ করেছেন সেটা আমাদের পুনর্বাসন প্রকল্পে পরিবারের লোকজন বরাদ্দ পেয়েছে।’
মাহবুব হাসানের বাড়ি দখল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মাহবুবের ভাই মেহেদীর কাছ থেকে একটি প্লট ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব চাচা ক্রয় করেন। তার কাছ থেকে ২২ লাখ টাকায় আমি কিনেছি। সেই প্লট নিয়ে যে ঝামেলা ছিল সেটা পল্লবী থানা জোনের কর্মকর্তারা বসে মীমাংসা করে দিয়েছেন।’
যুবলীগের এ নেতা আরও বলেন, ‘আমি মাদ্রাসা ও মসজিদ এবং এনডিসি স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি। আমি চাঁদাবাজি-ধান্ধাবাজিতে জড়িত থাকলে এমপি সাহেব আমাকে এসব দায়িত্ব দিতেন না।’