ঢাকা ১২:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘শুরেশ্বরী ডাটা, পদ্মার ইলিশ আর খেজুরের গুড় এই তিনে শরীয়তপুর

ডেস্ক রিপোর্ট :
  • আপডেট টাইম : ০৭:২৬:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২১
  • / 84

‘শুরেশ্বরী ডাটা, পদ্মার ইলিশ আর খেজুরের গুড় এই তিনে শরীয়তপুর।’শরীয়তপুরের খেজুরের রস এবং সেই রস থেকে বানানো খেজুরের গুড় জেলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শীতের মৌসুমে খেজুরের রস আর গুড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে শরিয়তপুরের গ্রামগুলো। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারি গাছিরা সকাল হওয়ার আগেই বের হয়ে পড়েন রস সংগ্রহে। গ্রামের আশেপাশে, মাঠের মধ্যে থাকা খেজুর গাছে দক্ষতার সাথে উঠে যান এবং সেখান থেকে ভাড় (মাটির তৈরী পাত্র, কলসীর ছোট ভার্সন) নামিয়ে নিয়ে আসেন।

সকাল বেলা খেজুর রস খাওয়ার ঐতিহ্যঃ

ঠান্ডা খেজুরের রসের সাথে মুড়ি যেন অমৃত। বাড়ির সকলের সকালের নাস্তা সারা হয়ে যায় ঠান্ডা খেজুর রস আর মুড়ি দিয়ে। আর অন্যদিকে চলতে থাকে রস জ্বালানোর কাজ। সময়ের সাথে সাথে এই রস পরিণত হয় সুস্বাদু গুড়ে। এই রস ও গুড় বাজারে বিক্রি করে চলতো গাছি পরিবার।

শীতের ঐতিহ্যবাহী নানা পিঠা ও পায়েশের মূল উপাদান এই খেজুর রস ও গুড়। খেজুর গুড়ের তৈরী নানা পিঠা শরীয়তপুরের ঘরে ঘরেই পাওয়া যায়। বাড়িতে কোন অতিথি এলেই আপ্যায়নের জন্য দেওয়া হয় এসব পিঠা-পায়েস।

কয়েক বছর আগেও খেজুর গুড়ে উৎপাদন ও তা বিপণনের কাজে যুক্ত ছিল বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ। গাছি থেকে শুরু করে এলাকার কামার,কুমার, বাঁশ শিল্পী, আড়ৎদার, পাইকার, পরিবহনকারী, দোকানদানসহ অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভর করে ছিল খেজুর রস ও গুড়ের উপরে।

অতীতে শরীয়তপুরের গুড় শুধু এই জেলায় নয়, বিখ্যাত ছিলো সারাদেশে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় ইটভাটায় খেজুরগাছ পোড়ানোর ফলে হারিয়ে যাওয়ার পথে শরীয়তপুরের এই বিখ্যাত রস ও গুড়। গাছ না থাকায় গাছিরাও পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

বর্তমান অবস্থাঃ পূর্বে এই পেশার সাথে জড়িত একজন জানালেন, খেজুরের রস সংগ্রহ করার জন্য আগে অনেক গাছ ছিল। কিন্তু নানা কারণে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে এখন খেজুর রস সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়েছে। তাছাড়া খেজুরের রস থেকে গুড় প্রস্তুত করার জন্য প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হয়। পূর্বে শরীয়তপুরের মাঠে মাঠে প্রচুর পরিমাণে হওয়া আমন ও আউশ ধানের খড় থেকে এসব জ্বালানি সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে কৃষকরা বোরো ধান চাষ করায় আর আগের মতো জ্বালানি পাওয়া যায় না। উচ্চমূল্যে কাঠ কিনে গুড় উৎপাদন করতে অনেক খরচ বেড়ে যায়।

ফলে খেজুর গুড় বানানো স্থানীয় কৃষকদের জন্য কষ্টকর হচ্ছে। অনেকে এই সমস্যার কারণে খেজুরগাছ বিক্রি করে দিয়ে আসবাব উপযোগী গাছ রোপন করছেন। যার প্রভাব পড়ছে শরীয়তপুরের খেজুর গুড় শিল্পের ওপর। ডামুড্যা উপজেলার সৈয়দবস্তা গ্রামের প্রবীণ নারী পিয়ারা বেগম জাতীয় একটি  বলেন, শীতের সময় আমাদের বাড়ির ছেলেরা বুড়িহাট ডামুড্যা খালের দুই পাড়ের খেজুর বাগান থেকে সন্ধ্যা রাতের রস এনেই রসের নাস্তা তৈরি করে খেত। আর সকাল বেলা রস কম পেয়ে গাছিরা বকাবাদ্য করতো। যা বর্তমান কালে শুধুই কল্পকাহিনী।

ভেদরগঞ্জ উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব গাছি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আজ থেকে ৫-৬ বছর পূর্বেও আমাদের গ্রামে শত শত খেজুর গাছ ছিল। আমি প্রতিদিনই পালা করে দুই শতাধিক খেজুর গাছের রস আহরণ করতাম। প্রতিদিন আমার দুই থেকে আড়াই মণ গুড় উৎপাদন হতো। যা বিক্রি করে আমার সংসার স্বাচ্ছন্দ্যে চলতো। কিন্তু আজ তা শুধুই স্মৃতি। ইট ভাটার জ্বালানির জন্য নির্বিচারে খেজুর গাছ কেটে বিক্রি করে দেয়ায় এখন আর সারা গ্রাম খুঁজেও ২০-৩০টির বেশি খেজুর গাছ পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়েই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।’

নিউজ লাইট ৭১

Tag :

শেয়ার করুন

‘শুরেশ্বরী ডাটা, পদ্মার ইলিশ আর খেজুরের গুড় এই তিনে শরীয়তপুর

আপডেট টাইম : ০৭:২৬:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২১

‘শুরেশ্বরী ডাটা, পদ্মার ইলিশ আর খেজুরের গুড় এই তিনে শরীয়তপুর।’শরীয়তপুরের খেজুরের রস এবং সেই রস থেকে বানানো খেজুরের গুড় জেলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শীতের মৌসুমে খেজুরের রস আর গুড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে শরিয়তপুরের গ্রামগুলো। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারি গাছিরা সকাল হওয়ার আগেই বের হয়ে পড়েন রস সংগ্রহে। গ্রামের আশেপাশে, মাঠের মধ্যে থাকা খেজুর গাছে দক্ষতার সাথে উঠে যান এবং সেখান থেকে ভাড় (মাটির তৈরী পাত্র, কলসীর ছোট ভার্সন) নামিয়ে নিয়ে আসেন।

সকাল বেলা খেজুর রস খাওয়ার ঐতিহ্যঃ

ঠান্ডা খেজুরের রসের সাথে মুড়ি যেন অমৃত। বাড়ির সকলের সকালের নাস্তা সারা হয়ে যায় ঠান্ডা খেজুর রস আর মুড়ি দিয়ে। আর অন্যদিকে চলতে থাকে রস জ্বালানোর কাজ। সময়ের সাথে সাথে এই রস পরিণত হয় সুস্বাদু গুড়ে। এই রস ও গুড় বাজারে বিক্রি করে চলতো গাছি পরিবার।

শীতের ঐতিহ্যবাহী নানা পিঠা ও পায়েশের মূল উপাদান এই খেজুর রস ও গুড়। খেজুর গুড়ের তৈরী নানা পিঠা শরীয়তপুরের ঘরে ঘরেই পাওয়া যায়। বাড়িতে কোন অতিথি এলেই আপ্যায়নের জন্য দেওয়া হয় এসব পিঠা-পায়েস।

কয়েক বছর আগেও খেজুর গুড়ে উৎপাদন ও তা বিপণনের কাজে যুক্ত ছিল বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ। গাছি থেকে শুরু করে এলাকার কামার,কুমার, বাঁশ শিল্পী, আড়ৎদার, পাইকার, পরিবহনকারী, দোকানদানসহ অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভর করে ছিল খেজুর রস ও গুড়ের উপরে।

অতীতে শরীয়তপুরের গুড় শুধু এই জেলায় নয়, বিখ্যাত ছিলো সারাদেশে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় ইটভাটায় খেজুরগাছ পোড়ানোর ফলে হারিয়ে যাওয়ার পথে শরীয়তপুরের এই বিখ্যাত রস ও গুড়। গাছ না থাকায় গাছিরাও পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

বর্তমান অবস্থাঃ পূর্বে এই পেশার সাথে জড়িত একজন জানালেন, খেজুরের রস সংগ্রহ করার জন্য আগে অনেক গাছ ছিল। কিন্তু নানা কারণে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে এখন খেজুর রস সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়েছে। তাছাড়া খেজুরের রস থেকে গুড় প্রস্তুত করার জন্য প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হয়। পূর্বে শরীয়তপুরের মাঠে মাঠে প্রচুর পরিমাণে হওয়া আমন ও আউশ ধানের খড় থেকে এসব জ্বালানি সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে কৃষকরা বোরো ধান চাষ করায় আর আগের মতো জ্বালানি পাওয়া যায় না। উচ্চমূল্যে কাঠ কিনে গুড় উৎপাদন করতে অনেক খরচ বেড়ে যায়।

ফলে খেজুর গুড় বানানো স্থানীয় কৃষকদের জন্য কষ্টকর হচ্ছে। অনেকে এই সমস্যার কারণে খেজুরগাছ বিক্রি করে দিয়ে আসবাব উপযোগী গাছ রোপন করছেন। যার প্রভাব পড়ছে শরীয়তপুরের খেজুর গুড় শিল্পের ওপর। ডামুড্যা উপজেলার সৈয়দবস্তা গ্রামের প্রবীণ নারী পিয়ারা বেগম জাতীয় একটি  বলেন, শীতের সময় আমাদের বাড়ির ছেলেরা বুড়িহাট ডামুড্যা খালের দুই পাড়ের খেজুর বাগান থেকে সন্ধ্যা রাতের রস এনেই রসের নাস্তা তৈরি করে খেত। আর সকাল বেলা রস কম পেয়ে গাছিরা বকাবাদ্য করতো। যা বর্তমান কালে শুধুই কল্পকাহিনী।

ভেদরগঞ্জ উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব গাছি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আজ থেকে ৫-৬ বছর পূর্বেও আমাদের গ্রামে শত শত খেজুর গাছ ছিল। আমি প্রতিদিনই পালা করে দুই শতাধিক খেজুর গাছের রস আহরণ করতাম। প্রতিদিন আমার দুই থেকে আড়াই মণ গুড় উৎপাদন হতো। যা বিক্রি করে আমার সংসার স্বাচ্ছন্দ্যে চলতো। কিন্তু আজ তা শুধুই স্মৃতি। ইট ভাটার জ্বালানির জন্য নির্বিচারে খেজুর গাছ কেটে বিক্রি করে দেয়ায় এখন আর সারা গ্রাম খুঁজেও ২০-৩০টির বেশি খেজুর গাছ পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়েই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।’

নিউজ লাইট ৭১